শর্করা জাতীয় খাবার কি কি আমাদের সকলের জন্যে একটি প্রয়োজনীয় তথ্য। স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে হলে আপনাকে অবশ্যই শর্করা জাতীয় খাবার গ্রহণ করতে হবে। কারণ শর্করা হচ্ছে খাদ্যের মৌলিক উপাদানগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি। শর্করা জাতীয় খাবার এড়ানো খুবই কঠিন একটি ব্যাপার। সেগুলোর ভেতর আছে চিনি, ফল, দুগ্ধ ও সবজি। আমাদের শরীর যেসব খাবার থেকে শক্তি সঞ্চয় করে তার একটি হচ্ছে শর্করা জাতীয় খাবার। শর্করা জাতীয় খাবার শক্তির অন্যতম উৎস হিসাবে বিবেচিত। মানুষের প্রতিদিনের খাবারের মোট ক্যালরির ৫৫ থেকে ৬০ শতাংশ শর্করা থাকা উচিত বলে চিকিৎসকরা বলে থাকেন। সুষম খাবার গ্রহণ করতে গেলে খাবারের সব কটি উপাদান যেমন শর্করা, চর্বি, আমিষ যার যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু খেতে হবে। কোনোটাই যেমন বাদ দেওয়া যাবে না আবার অতিরিক্ত খাওয়াও যাবে না। আমাদের সারা দিনের খাদ্যতালিকার অন্যতম উপাদান হচ্ছে শর্করা জাতীয় খাবার। ভাত হচ্ছে তার প্রধান মাধ্যম। যত কিছুই খাই না কেন ভাত না খেলে ঠিক তৃপ্তি আসে না। এক দিন অথবা এক বেলা ভাত না খাওয়ার কথা আমরা অনেকে চিন্তাও করতে পারি না। প্রতিদিন দুই বা তিন বেলাই ভাত খেয়ে থাকেন আমাদের দেশের প্রায় ৯০ ভাগ মানুষ।
শর্করা জাতীয় খাদ্য কাকে বলে?
মানুষের প্রধান খাদ্য শর্করা বা কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবার। হাইড্রোজেন, কার্বন এবং অক্সিজেন নিয়ে শর্করা তৈরি হয়। শর্করা গন্ধহীন, বর্ণহীন এবং অল্প মিষ্টি স্বাদযুক্ত খাবার। মানুষের শরীরে কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করে শর্করা জাতীয় খাবার। শরীরে উৎপাদন করে তাপশক্তিও। শর্করা জাতীয় খাদ্যকে ইংরেজিতে কার্বোহাইড্রেট বলা হয়ে থাকে। কার্বোহাইড্রেট বলতে যে সকল খাদ্য খাদ্যের মূল উপাদান হাইড্রোজেন, কার্বন ও অক্সিজেন তাদেরকে বোঝানো হয়ে থাকে। ক্ষুধা মেটাতে আমরা যে সকল খাদ্য গ্রহণ করে থাকি তার বেশিরভাগই মূলত কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাদ্য। যেমন: রুটি, পাউরুটি, ভাত, চাল ও চিনি ইত্যাদি সবই শর্করা জাতীয় খাদ্য। পুষ্টি বিজ্ঞানীরা মনে করেন একজন মানুষের দৈনিক গ্রহণ করা খাদ্যের মধ্যে কমপক্ষে ৪৫ থেকে ৬০ শতাংশ কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা জাতীয় খাবার থাকা উচিত। অর্থাৎ বুঝতেই পারছেন একদিনে আমরা যা খাই তার অর্ধেকের বেশি শর্করা জাতীয় খাবার হয়ে থাকে। একজন প্রাপ্ত বয়স্ক একজন মানুষের প্রতিদিন গড়ে ৩০০ গ্রাম শর্করা খাওয়া উচিত।
শর্করা জাতীয় খাবার কি কি?
শর্করা আমরা সারাদিন কোন না কোনভাবে খেয়েই থাকি। কারন আমাদের প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় যেসকল খাদ্য পরিচিতি লাভ করেছে তার প্রতিটিই প্রায় শর্করা জাতীয় খাবার। নিচে শর্করা জাতীয় খাবার কি কি এবং কোন খাবারের মধ্যে কি পরিমান শর্করা বিদ্যমান থাকে তার একটি উল্লেখযোগ্য তালিকা উল্লেখ দেওয়া হলোঃ
১। ভাত
আমরা বাঙ্গালী। অঞ্চলভেদে বাংলাদেশে প্রচুর পরিমানে ধান চাষ হওয়ায় ভাত আমাদের প্রধান খাবার। তার উপর দামে সস্তা এবং আবার সহজে পাওয়া যায়। ভাত একটি শর্করা জাতীয় খাবার। প্রতি ১০০ গ্রাম ভাত এর মধ্যে শর্করার পরিমান ৭৭.৯ গ্রাম।
২। রুটি
বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান দেশ। আবার নদী মাতৃক দেশ হওয়ায় বিভিন্ন ধরনের কৃষিজ পন্য উৎপাদিত হয়ে থাকে। তার মধ্যে গম একটি। গমের আটা থেকে তৈরি এদেশের মানুষের দ্বিতীয় প্রধান খাবার। গম একটি শর্করা জাতীয় খাবার প্রতি ১০০ গ্রাম আটা এর মধ্যে শর্করার পরিমান ৪৯.৭ গ্রাম।
৩। মটর ডাল
বাংলাদেশে স্থলভাগের প্রায় এক তৃতীয়াংশ চরাঞ্জল। নদীর পলির কারনে এই সব চরাঞ্চলে প্রচুর ফসল উৎপন্ন হয়। মটর ডাল তার মধ্যে একটি। মটর ডাল একটি শর্করা জাতীয় খাবার। প্রতি ১০০ গ্রাম মটর ডালে শর্করার পরিমান প্রায় ৪৮.৩ গ্রাম।
৪। তেজপাতা
বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ হওয়া নানা ধরনের ফসল উৎপাদিত হয়। তার উপর আবার অসংখ্য নদী ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে এই দেশের চারিদিকে। তেজপাতা একটি শর্করা জাতীয় খাবার। প্রতি ১০০ গ্রাম তেজপাতা এর মধ্যে শর্করা প্রায় ৪৮.৭ গ্রাম।
৫। গুঁড়ো দুধ (ননী ছাড়া)
বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ হওয়া নানা ধরনের ফসল উৎপাদিত হয়ে থাকে এই দেশে। উর্বর মাটি হওয়ায় পশু পালনের আদর্শ চারনভূমি বলা এই দেশকে। গুড়োদুধ একটি শর্করা জাতীয় খাবার। প্রতি ১০০ গ্রাম গুড়োদুধ এর মধ্যে শর্করা প্রায় ৪৯.৮ গ্রাম।
৬। পাউরুটি
পাউরুটি একটি শর্করা জাতীয় খাবার। পাউরুটি সাধারনত আটা থেকে তৈরি করা হয়ে থাকে। প্রতি ১০০ গ্রাম পাউরুটি এর মধ্যে শর্করা প্রায় ৫৫.৬ গ্রাম।
৭। খেসারি ডাল
বাংলাদেশে প্রচুর পরিমানে খেসারি ডাল উৎপন্ন হয়। খেসারি ডাল একটি শর্করা জাতীয় খাবার। প্রতি ১০০ গ্রাম খেসারি ডালের মধ্যে শর্করা থাকে প্রায় ৫৫.৫ গ্রাম।
৮। ছোলার ডাল
বাংলাদেশের আরেকটি কৃষিজ পন্য হলো ছোলার ডাল। বাংলাদেশে প্রচুর পরিমানে ছোলার ডাল উৎপন্ন হয়। ছোলার ডাল একটি শর্করা জাতীয় খাবার। প্রতি ১০০ গ্রাম ছোলার ডালের মধ্যে শর্করা থাকে প্রায় ৪৯.২ গ্রাম।
৯। মিষ্টি তেঁতুল
বাংলাদেশের আরেকটি পরিচিত খাদ্য হলো মিষ্টি তেঁতুল। একসময় বাংলাদেশে প্রচুর পরিমানে উৎপন্ন হলেও এখন আর বেশি দেখা যায় না। মিষ্টি তেঁতুল একটি শর্করা জাতীয় খাবার। প্রতি ১০০ গ্রাম মিষ্টি তেঁতুলের মধ্যে শর্করা থাকে প্রায় ৬০.৮ গ্রাম।
১০। মুগ ডাল
বাংলাদেশের আরেকটি কৃষিজ পন্য হলো মুগ ডাল। বাংলাদেশে প্রচুর পরিমানে মুগ ডাল উৎপন্ন হয়। মুগ ডাল একটি শর্করা জাতীয় খাবার। প্রতি ১০০ গ্রাম মুগ ডালের মধ্যে শর্করা থাকে প্রায় ৬০.৯ গ্রাম।
১১। মাসকলাই ডাল
আমাদের সকলের কাছেই একটি পরিচিত ও সুস্বাদু খাবার হলো মাসকলাই এর ডাল। মাসকলাই একটি শর্করা জাতীয় খাবার। প্রতি ১০০ গ্রাম মাসকলাই এর মধ্যে শর্করার পরিমান প্রায় ৬১.৮ গ্রাম।
১২। লাল আটা
আমাদের দেশে উৎপাদিত গমের আরেকটি প্রজাতি হলো লাল আটা। পুষ্টিগুরে সমৃদ্ধ একটি খাবার এটি। আল আটাও একটি শর্করা জাতীয় খাবার। প্রতি ১০০ গ্রাম লাল আটা এর মধ্যে ৬২.২ গ্রাম শর্করা বিদ্যমান।
১৩। সাদা আটা
গম তৈরি হয় আটা। যেহেতু গম একটি শর্করা জাতীয় খাবার তাই সাদা আটাও শর্করা জাতীয় খাবার। প্রতি ১০০ গ্রাম সাদা আটার মধ্যে ৭০.৩ গ্রাম শর্করা থাকে।
১৪। সুজি বা গম
সুজি মূলত গম থেকে তৈরি হয় তাই সুজি একটি শর্করা জাতীয় খাবার । প্রতি ১০০ গ্রাম সুজি এর মধ্যে শর্করা রয়েছে প্রায় ৭০.৬ গ্রাম।
১৫। ময়দা
ময়দাও গম থেকে তৈরি হয়ে থাকে। তাই ময়দাও একটি শর্করা জাতীয় খাবার। প্রতি ১০০ গ্রাম ময়দার মধ্যে শর্করা থাকে প্রায় ৭৩.১ গ্রাম।
১৬। চিড়া
মূলত ধান থেকে চিড়া তৈরি হয়। আগেই বলেছি ধান বা চাল হচ্ছ শর্করা জাতীয় খাবার। প্রতি ১০০ গ্রাম চিড়ার মধ্যে শর্করা থাকে প্রায় ৭৯.২ গ্রাম।
১৭। মুড়ি
মুড়িও তৈরি হয় চাল থেকেই। তাই বলা যায় মুড়ি একটি শর্করা জাতীয় খাবার। প্রতি ১০০ গ্রাম মুড়ির মধ্যে শর্করা থাকে প্রায় ৮২.৭ গ্রাম।
১৮। খৈ
খৈ মূলত ধান ধেকে তৈরি হয়। খৈ একটি শর্করা জাতীয় খাবার। প্রতি ১০০ গ্রাম খৈ এর মধ্যে শর্করা থাকে প্রায় ৮৭.০ গ্রাম। আনুপাতি হারে খৈ তে পরিমানে বেশি শর্করা বিদ্যমান।
১৯। মধু
মধু একটি প্রাকৃতি খুবই উপকারি একটি খাবার। মধু একটি শর্করা জাতীয় খাবার। প্রতি ১০০ গ্রাম মধুর মধ্যে শর্করা থাকে প্রায় ৮১.১ গ্রাম।
২০। চিনি
চিনিও একটি শর্করা জাতীয় খাবার। প্রতি ১০০ গ্রাম চিনির শর্করা থাকে প্রায় ৯৯.৫ গ্রাম। দেখা যাচ্ছে সকল খাদ্যের চেয়ে চিনিতে আনুপাতিক হারে শর্করা বেশি বিদ্যমান। তাই বেশি বেশি চিনি খাওয়া উচিত নয়।
শর্করা জাতীয় খাবার খাওয়ার সময় আমাদেরকে অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে বিশেষ করে ডায়াবেটিস রোগীদের আরও একটু বেশি সচেতন থাকতে হবে। এই খাদ্য উপাদানটি শরীরের মধ্যে রক্তের সুগার লেভেল দ্রুত বৃদ্ধি করে থাকে। সচেতন থাকার জন্য আপনারা উপরে উল্লেখিত নিয়ম অনুসারে শর্করা গ্রহণ করতে পারেন।
বহুল জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন ও উত্তর সমূহ
শর্করা জাতীয় খাবার কি কি এই বিষয়ে আপনাদের মনে বেশ কিছু পশ্ন থাকতে পারে। তবে চলুন জেনে নেওয়া যাক সেই সমস্ত সকল প্রশ্ন ও তার উত্তর।
শর্করা জাতীয় খাদ্য কত প্রকার?
শক্তির উৎস হিসেবে দেহ শর্করাকেই বেশি প্রাধান্য দেয়। কারন শর্করা সহজে ও দ্রুত ভেঙে শরীরে শক্তির যোগান দেয়। যা আমিষ বা চর্বি ভাঙার চেয়ে দ্রুততর। শর্করা সাধারনত দুই প্রকার যথাঃ সরল ও জটিল শর্করা। আমাদের খাওয়া শর্করার মধ্যে অধিকাংশই হচ্ছে জটিল শর্করা যা ভাঙতে অধিক পরিশ্রম ও সময়ের প্রয়োজন হয়।
প্রতিদিন কতটুকু শর্করা খেতে হবে?
প্রতিদিন কতটুকু শর্করা খাবেন তা নির্ভর করে আপনার বয়স, ওজন ও কাজের পরিমাণ ইত্যাদির ওপর। তবে একজন প্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তির স্বাভাবিক মাত্রা ধরা হয় দিনে ৩০০ গ্রাম।তবে ওজন কমানোর লক্ষ্যে আপনি সেটা কমিয়ে ৫০ -১৫০ গ্রাম পর্যন্ত আনতে পারেন ।
উপসংহার
কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা জাতীয় খাবার এর মূল উপাদান হচ্ছে কার্বন, হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন এর সম্মিলিত রুপ। এই তিনটি উপাদান আমাদের দেহের শক্তি উৎপাদনের জন্য প্রধান কাঁচামাল হিসাবে কাজ করে থাকে। বেঁচে থাকার জন্য আমাদের শক্তি প্রয়োজন। শক্তি ছাড়া আমাদের দেহ বিন্দু পরিমাণও কাজ করতে সক্ষম নয়। আমরা যদি শর্করা জাতীয় খাদ্য গ্রহণ না করি তবে আমাদের দেহ কাজ করা বন্ধ করে দিবে। তাই কেউ যদি কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবার না খায় তবে তার সম্পূর্ণ দেহ অচল হয়ে যাবে এবং ক্রমে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হতে থাকবে। কেননা শক্তি ছাড়া কোনো প্রানী কখনোই চলতে পারে না। বেশি পরিমাণ চিনি খেলে আমাদের শরীরের ডায়াবেটিস রোগের দেখা দিতে পারে। এ রোগকে বলা হয় নীরব ঘাতক একটি রোগ।
একবার যদি ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত হয় সেক্ষেত্রে আর এই রোগ থেকে মুক্তির পাওয়ার কোন উপায় নেই। সারা জীবন এই রোগকে বয়ে চলতে হয়। যার কারনে মিষ্টি জাতীয় খাদ্যকেও সারা জীবনের জন্য না বলতে হয়। তাই কোন খাদ্য খাওয়ার পূর্বে অবশ্যই জেনে নেওয়া উচিত শর্করা জাতীয় খাবার কি কি। এছাড়াও আপনার জ্ঞানকে প্রসারিত করতে শরীর ফিট রাখার ১০ টি উপায় সম্পর্কে পড়তে পারেন।
“শর্করা জাতীয় খাবার কি কি” এই বিষয়ে আপনার যদি কিছু জানার থাকে তবে আপনি এই পোস্টের নিচে মন্তব্য করতে পারেন। এছাড়াও এই পোস্ট-টি তথ্যবহুল মনে হলে আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করতে পারেন। ধন্যবাদ।