মাটি দূষণের ৫টি কারণ সম্পর্কে জেনে মাটি দূষণে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারেন। কমবেশি সবারি জানার কথা। পরিবেশের বিভিন্ন উপাদান এর মধ্যে মাটি একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। মাটির ওপর নির্ভর করে সমস্ত জীবজগৎ বসবাস করছে। মাটি কে ব্যবহার করে সমস্ত প্রাণী ও উদ্ভিদ। মাটি ও মানুষের রয়েছে গভীর সম্পর্ক। সেই অর্থে মৃত্তিকা কে মা বলে মনে করা হয়। কিন্তু সেই মাকে আজকাল সমস্ত প্রাণী বিশেষ করে মানুষ দূষিত করে তুলেছে। এত মাত্রায় অবাঞ্ছিত পদার্থ মাটিতে নিক্ষেপ করা হচ্ছে যে মাটির সমস্ত গুণগত মান নষ্ট হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। মাটি দূষিত হয়ে পড়ছে বিভিন্ন ভাবে । পরিবেশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তিনটি উপাদান হচ্ছে মাটি, পানি ও বায়ু। এই উপাদানগুলো পৃথিবীর বুকে প্রাণিকুলের বেঁচে থাকার জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। কিন্তু বর্তমানে এই মাটিকে নানাভাবে দূষিত করা হচ্ছে। কৃষিকাজে বহুল ব্যবহত বিভিন্ন রাসায়নিক কীটনাশক ও সার ভূমিদূষণকে আরও বেশি ত্বরান্বিত করছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার নির্দেশিত হিসেবে মাটি দূষণ একটি বিশ্বব্যাপী হুমকি যা বিশেষত ইউরোপ, এশিয়া ও উত্তর আফ্রিকার মতো অঞ্চলে মারাত্মক।
মাটি দূষণ কাকে বলে?
পানিস্রোত, হিমবাহ, অগ্ন্যুৎপাত, রোদ, বৃষ্টি, বায়ুপ্রবাহ, ভূমিকম্প প্রভৃতি প্রাকৃতিক শক্তির প্রভাবে শিলারাশি চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে পৃথিবী পৃষ্ঠের উপরিভাগে যে নরম আবরণ তৈরি হয়েছে তাকে মাটি বলে। মাটির উপরই আমরা বসবাস করি এবং গাছপালাসহ নানা ধরনের ফসল উৎপাদন করে জীবনধারণ করে থাকি। তেজষ্ক্রিয় বর্জ্য, জমাকৃত আবর্জনা, শিল্প বর্জ্য, কৃষি বর্জ্য, এবং বিভিন্ন জৈব উপাদান মৃত্তিকার যে ক্ষতিসাধন করে তাই হলো মৃত্তিকা দূষণ। আবার অতিরিক্ত রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারের কারণেও মাটি দূষিত হয়। এছাড়াও প্লাস্টিক, হাসপাতালের বর্জ্য, পলিথিন ইত্যাদির ফলে যে উপাদান দূষিত হয় তাকেও মাটি দূষণ বলে। মাটি দূষণ বা মৃত্তিকা দূষণ বলতে রাসায়নিক বর্জ্যের নিক্ষেপ কিংবা ভূ-গর্ভস্থ ফাটলের কারণে নিঃসৃত বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থের মিশ্রণের কারণে মূলত জমির উর্বরতা শক্তি নষ্ট হওয়াকে বুঝানো হয়ে থাকে।
মাটি দূষণের ৫টি কারণ
পৃথিবীর বুকে মাটি এক গুরুতবপূর্ন সম্পদ। মাটির উপরের স্তরের উৎকর্ষ মানের ওপরেই মাটির উর্বরতা ও উৎপাদনশীলতা নির্ভর করে থাকে। কিন্তু মানুষ কর্তৃক সৃষ্ট বিভিন্ন দূষণের ফলে মাটির ওপরের স্তরের এই পুষ্টি পদার্থ দিন দিন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। মাটিতে বাহিরের জৈব ও অজৈব উপাদানের সংযোজন ঘটছে প্রতিনিয়ত। সাধারণত মাটি দূষণের ক্ষেত্রে সে সকল কারণগুলো কাজ করে থাকে নিয়েই মূলত আজকের আলোচনা। নিচে গুরুত্বপূর্ণ মাটি দূষণের ৫টি কারণ সংক্ষেপে আলোচনা করা হল-
১। শিল্প-কারখানার বর্জ্য
মাটি দূষনের অনেকগুলো কারনের মধ্যে এটি একটি অন্যতম প্রধান কারন। শিল্প-কারখানার বর্জ্য পদার্থ মাটির সাথে মিশে মাটি দূষণ ঘটায়। শিল্প-কারখানার কঠিন বর্জ্য, রাসায়নিক উপাদান প্রভৃতি দীর্ঘদিন যাবত মাটিতে মিশলে মাটি তার স্বাভাবিক গুণাগুণ হারিয়ে ফেলে এবং মাটির উর্বরতা শক্তি নস্ট হয়ে যায়। তাই এখনি আমাদের সচেতন না হলে বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে।
২। কৃষি ও গৃহস্থালি বর্জ্য
মাটি দূষনের আরেকটি কারন হলো কৃষি ও গৃহস্থালি বর্জ্য। গবাদি পশুর মলমূত্র,ফসলের পরিত্যক্ত অংশ জমানো এবং পোড়ানো, কৃষি যন্ত্রপাতির অবশিষ্টাংশ দীর্ঘদিন ধরে মাটিতে ফেলে রাখলে মাটির গুণাগুণের উপর প্রভাব পড়ে এবং মাটির উর্বরতা শক্তি আস্তে আস্তে হ্রাস পেতে থাকে। এছাড়া গৃহস্থালি কাজে ব্যবহৃত জিনিসপত্রের অবশিষ্টাংশ, খাদ্যের আঁশ, মিউনিসিপ্যালের বর্জ্য, প্রাণি বর্জ্য, পলিথিন ইত্যাদি মাটিতে পড়ে থাকলে মাটি দূষিত হয়। এই দূষনটি রোধ করতে প্রয়োজন শুধু একটু সচেতনতা।
৩। রাসায়নিক সার ও কীটনাশক
মৃত্তিকা দূষণের অন্যতম প্রধান কারণ হলো রাসায়নিক সার ও কীটনাশক এর বেশি বেশি ব্যবহার। ক্রমবর্ধিষ্ণু জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে জমিতে অধিক হারে ফসল ফলানোর জন্য অধিক হারে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করা হয়ে থাকে। সাধারনত কীটনাশকের বিষক্রিয়া দীর্ঘদিন যাবৎ মাটির সাথে মিশে থাকে যা মাটির উর্বরতা হ্রাস, কেঁচোসহ উপকারী কীটপতঙ্গ এবং বিভিন্ন অনুজীব ধ্বংস করে থাকে। তাছাড়া রাসায়নিক সার ব্যবহারের পুনরাবৃত্তির ফলে মৃত্তিকায় অপ্রয়োজনীয় রাসায়নিক যৌগের পরিমাণ বাড়ে এবং অন্যদিকে হিউমাস ও নাইট্রোজেনের মাত্রা কমে যায়। এভাবে মাটি দিনে দিনে তার উর্বরতা হারায় ফলে মাটি দূষিত হতে থাকে।
৪। বন উজাড়
মাটি একটি শ্রেষ্ট প্রাকৃতিক উপহার। মাটিকে কেন্দ্র করেই মূলত এই পৃথিবরীর জীবের বংশ বৃদ্ধি। মাটির জন্যই মূলত আজ জীবের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। গাছপালা পরিবেশের ভারসাম্য করে করে মানুষকে বসবাসের উপযোগী পরিবেশ করে দেয়। কিন্তু ব্যাপকহারে গাছপালা বা বন উজাড় করলে গাছপালার অভাবে মাটির আর্দ্রতা এবং হিউমাস কমে গিয়ে মাটির উর্বরতা শক্তি হ্রাস পায় এবং মাটি দূষণ ঘটে।
৫। চিকিৎসা বর্জ্য
মাটি দূষনের নানা উপকরনের মধ্যে চিকিৎসা বর্জ্য একটি নিয়ামক। সাধারনত প্রতিদিনের চিকিৎসা ক্ষেত্রে ব্যবহৃত বিভিন্ন সরঞ্জাম যেমন- সিরিঞ্জ, ব্যান্ডেজ ইত্যাদি দীর্ঘদিন মাটিতে ফেলে রাখলে মাটির গুণগতমান ধীরে ধীরে নষ্ট হতে থাকে। মাটির ভিতরের উপকারী কীটপতঙ্গগুলো আক্রান্ত হয় এবং যার ফলে মাটি দূষণ ঘটে। এছাড়া মানুষের মলমূত্র, পারমানবিক পরীক্ষা, জলাবদ্ধতা প্রভৃতি কারণেও মাটি দূষিত হয়ে থাকে। মাটি দূষন মানে জীবের জন্য ধ্বংশ ডেকে নিয়ে আসা। জীবের অস্তিত্ব মূলত এই মাটিকে ঘিরে।
বহুল জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন ও উত্তর সমূহ
মাটি দূষণের ৫টি কারণ এই বিষয়ে আপনাদের মনে বেশ কিছু পশ্ন থাকতে পারে। তবে চলুন জেনে নেওয়া যাক সেই সমস্ত সকল প্রশ্ন ও তার উত্তর।
মাটি দূষণের প্রতিকারের উপায় গুলি কি কি?
প্রতিদিন বিভিন্নভাবে মাটি দূষিত হচ্ছে। সময়মত দূষন প্রতিরোধ করতে বা না পারলে একসময় হয়তো পৃথিবীতে আর জীবের অস্তিত্ব থাকবে না। নির্দিষ্ট জায়গায় ময়লা ও আবর্জনা ফেলে, জমিতে রাসায়নিক সারের পরিবর্তে জৈব সার যেমনঃ কম্পোষ্ট সার ব্যবহার করে, পলিথিন ব্যবহারের পরিবর্তে পাটের তৈরি ব্যাগ ব্যবহার করে, পলিথিন জাতীয় জিনিসপত্রের ব্যবহার কমিয়ে দিয়ে ও পুন:ব্যবহার করে এবং সবশেষে বনভূমি ধ্বংস না করে বরং বেশি করে গাছ লাগিয়ে মাটি দূষন প্রতিরোধ করতে পারি।
মাটি দূষণের প্রধান কারন কোনটি?
মাটি বিভিন্নভাবে প্রতিনিয়মত দূষিত হয়ে চলেছে। শিল্পকারখানার উন্নতির ফলে এখন সদিচ্ছা থাকলেও আর এই দূষনের লাগাম টানা যাচ্ছে না। পৃথিবীতে সকল সমস্যার মূল কারন মানুষ। তাই মাটি দূষণের প্রধান কারণ সাধারণ মানুষের সচেতনতার অভাব । মানুষ সচেতন হলে মাটি দূষন কমিয়ে আনা সম্ভব।
উপসংহার
মাটি সকল জীবের অস্তিত্বের উৎস। তাই মাটিকে মায়ের সাথে তুলনা করা হয়েছে। মাটি দূষণের কারনে ভূমির উর্বরতা শক্তি হ্রাস পায়। দেশের জনসংখ্যার দ্রুত বর্ধনের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের যে পরিমাণ খাদ্যের প্রয়োজন ছিল সেখানে খাদ্যের ঘাটতির সৃষ্টি হচ্ছে এবং ফসলের গুণাগুণও নষ্ট হচ্ছে প্রতিনিয়ত। মাটিতে ব্যবহৃত রাসায়নিক উপাদানগুলো মাটির উর্বরতা শক্তি কমিয়ে দেয় যার ফলে তুলনামূলক খাদ্য উৎপাদন হ্রাস পায়। ফলে মানুষ তাদের পরিমিত খাদ্যসামগ্রী থেকে বঞ্চিত হচ্ছে দিনে দিনে। গাছপালা মাটি থেকে শিকড়ের মাধ্যমে পানি শোষণ করে এবং পশুপাখিও মাটি থেকে তাদের খাদ্যসামগ্রী খুঁজে নেয়। কিন্তু মাটি যদি বিষাক্ত হয়ে যায় তাহলে তা গাছপালা ও পশুপাখির উভয়ের জন্যেই মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাছাড়া দূষিত মাটিতে উদ্ভিদের উপকারী ব্যাকটেরিয়াও ধ্বংস হয়ে যায়। তাই আমাদের সচেতন হতে হবে এবং প্রধান প্রধান মাটি দূষণের ৫টি কারণ অবশ্যই জানতে হবে। এছাড়াও আপনার জ্ঞানকে প্রসারিত করতে পানি দূষণের ১০টি কারণ সম্পর্কে পড়তে পারেন।
“মাটি দূষণের ৫টি কারণ” এই বিষয়ে আপনার যদি কিছু জানার থাকে তবে আপনি এই পোস্টের নিচে মন্তব্য করতে পারেন। এছাড়াও এই পোস্ট-টি তথ্যবহুল মনে হলে আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করতে পারেন। ধন্যবাদ।