হাঁসের ঔষধ তালিকা জেনে রাখা প্রয়োজন সকল হাঁস খামারীর। এতে করে সঠিক সময় সঠিক ঔষুধের প্রয়োগ করতে পারেন। গৃহপালিত প্রাণিকুলের মধ্যে হাঁস আমাদের অতি সুপরিচিত। গ্রাম-বাংলায় শুধু গৃহপালিত প্রাণী হিসেবেই না, বরং বানিজ্যিক খামার করেও এখন পালন করা হচ্ছে হাঁস। কিন্তু হাঁস পালন করা হলেও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ঋতু ভেদে এখন নানারকম রোগ বালায় এর সম্মুখীন হতে হচ্ছে পালনকারীদের। ফলে হাঁসকে রোগ-বালাই থেকে সুস্থ রাখতে অনেক ঔষধের প্রয়োজন হয়।
হাঁস পালনকারীর নিকট হাঁসের রোগ বালাই মোতাবেক তার প্রতিষেধকের তালিকা থাকা অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ। অন্যথায়, হাঁস রোগাক্রান্ত হয়ে খামারে আর্থিকভাবে ব্যপক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে। তাই আজকের আর্টিকেলে আমরা রোগ-বালাই দমন করতে হাঁসের ঔষধ তালিকা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
হাঁসের রোগ-বালাই কী কী?
হাঁসের ঔষধ তালিকা সম্পর্কে জানতে হলে হাঁসের রোগ-বালাই সম্বন্ধে বিস্তারিত জানা আবশ্যক। হাসের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য যোগ্য রোগ হলো –
- ডাক কলেরা
- ডাক প্লেগ
- ডাক সেপটিমেসিয়া
- ডাক ভাইরাল হেপাটাইটিস
- মাইকোটক্সিকোসিস
- বটুলিজম
- আমাশয়
- এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা
- ব্রুডার নিউমোনিয়া
- হাঁসের কৃমি জনিত সমস্যা
উপরিউক্ত রোগ গুলোই হাঁসের প্রধান রোগ-বালাই হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তাছাড়া ছোট খাটো আরও কিছু অসুবিধা থাকলেও সেগুলো অধিকাংশ একই রোগের ঔষধ বা ভ্যাক্সিনে নিরাময় হয়। হাঁসের ঔষধ তালিকা করার সময় আমরা ক্রমেই বিস্তারিত আলোচনা করবো আরও।
হাঁসের ঔষধ তালিকা
হাঁসের ঔষধ তালিকা থেকে একটি হাঁসের বাচ্চাকে জন্মের পর থেকে সুস্থভাবে বেঁড়ে তুলতে চাইলে বয়স অনুযায়ী নিম্নোক্ত নিয়মে ঔষধ খাওয়াতে হবে। হাঁসের ঔষধ তালিকায় আমরা ভ্যাক্সিন ও ঔষধ ; উভয় বিষয়েই আপনাদের অবগত করবো।
ডাক প্লেগের টিকা (Duck Plague Vaccine)
হাঁসের চিকিৎসা সাময়িক অসুখ হওয়ার চেয়ে অনেক বেশি ভ্যাক্সিন নির্ভর। ডাক প্লেগ টিকা প্রয়োগের জন্য হাঁসের বয়স ২১-২৮ দিন হওয়া প্রয়োজন। ১৫ ডোজ দেওয়ার ১৫ দিন পর ৩৬-৪৩ দিন বয়সে হাঁসের ২য় ডোজ প্রদান করা হয়। দ্বিতীয় ডোজ কে বলা হয় বুস্টার ডোজ। তারপর প্রতি ৪-৫ মাস পরপর টিকা প্রদান করতে হয়। হাঁসের বুকের মাংস তে সাধারণত এই টিকা প্রয়োগ করতে হয়।
ডাক কলেরা টিকা (Duck Cholera Vaccine)
ডাক কলেরা টিকা প্রথম দিতে হয় ৪৫-৬০ দিন বয়সে। তারপর ৬০-৭৫ দিন বয়সে বুস্টার ডোজ দেওয়া হয়। পরবর্তী প্রতি ৪-৫ মাস পর একটি করে প্রদান করতে হয়। হাঁসের ডানার নিচে পালক ও শিরাবিহীন জায়গায় প্রয়োগ করতে হয় ডাক কলেরা টিকা। একটি হাঁস বাচ্চা থেকে বেড়ে উঠে প্রাপ্ত বয়স্ক হাঁস হওয়ার এই স ময়কালে যেকোনো রোগের তাৎক্ষণিক চিকিৎসার পাশাপাশি ভ্যাক্সিনের গুরুত্ব অনেক বেশি।
কসমিক্স প্লাস (Cosmix Plus)
কসমিক্স প্লাস ১-৩ দিন বয়সী বাচ্চাকে দিনে দুইবেলা খাওয়াতে হবে।
থাসুমিক প্লাস (Thasomic Plus)
৭-১২ দিন বয়সী বাচ্চাকে সকালে ১ বার করে খাওয়াতে হবে।
জিংক ভেট (Zinc Vet)
২২-২৫ দিন বয়সী বাচ্চাকে দিতে হবে। ডিম পাড়ার সময় আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
ভিটামিন এডি3ই (Vitamins AD3E)
সপ্তাহে ১-২ দিন চার সপ্তাহ বয়স পর্যন্ত খাওয়ানো প্রয়োজন খাবারের সাথে। রেনাসল এডি৩ই (Renasol AD3E), ভিটামিন এডি৩ই (Vitamina AD3E) ও ই এস এডিই (E S ADE) হচ্ছে তিনটি ভিন্ন কোম্পানির একই টাইপের ঔষধ।
ডব্লিউ এস(WS)
চার সপ্তাহ পর্যন্ত সপ্তাহে ২-৩ দিন খাওয়ানো লাগবে। এসি ভিট ডব্লিউ এস (ACIvit WS), রেনা ডব্লিউ এস ( Rena WS), বি কম ভিট, পিথি ডব্লিউ এস ( Becomvit,Prithi WS) হচ্ছে এই গ্রুপের তিনটি ভিন্ন কোপানির ঔষধ।
ই-সেল (E-Sell)
৩৫-৩৮ দিন বয়সী বাচ্চাকে দিতে হবে প্রতিদিন একবার। ডিম পাড়ার সময় আরও বেশি কার্যকর।
রেনামাইসিন (Renamycine)
৪৩-৪৭ দিন বয়সী বাচ্চাকে দিনে দুইবেলা খাওয়াতে হবে। কয়েকমাস অন্তর অন্তর প্রাপ্ত বয়স্ক হাঁস কে দিতে হবে।
ডক্সিসাইক্লিন (Doxicycline)
ডক্সাসিল ( Doxacil), ডক্সিভেট (Doxivet), এন্টিডক্স (Antidox) তিনটি একই টাইপের ঔষধের যেকোনো একটি ২-৩ লিটার পানিতে ১ গ্রাম করে খাওয়াতে হবে। ব্যাক্টেরিয়ার প্রতিরোধী হিসেবে ডক্সিসাইক্লিন দারুণ কার্যকর। তাছাড়া প্লেগ ভ্যাক্সিন ও কলেরা ভ্যাক্সিন এই সময়ের মধ্যে দিতে হবে নির্দিষ্ট সময়ে। সেই ব্যাপারে উপরে বিস্তারিত দেওয়া আছে।
ভিটামিন (Vitamin)
হাঁসের জন্মের পর থেকেই নিয়মিত ভিটামিন বি, সি ও ই ট্যাবলেট খাওয়ানো জরুরি। হাঁসের বাচ্চার ঘাড়ে সমস্যার প্রতিষেধক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। হাঁসের বাচ্চার যেকোনো দূর্বলতার জন্য ভিটামিন বি১ ও বি২ ব্যবহৃত হয়।
লিভার টনিক (Liver Tonic)
বাচ্চার শারিরীক সুস্থাতার জন্য লিভার টনিক খাওয়ানো উচিত।
আর্সেনিক(Arsenic)
হাঁসের বাচ্চার যেকোনো ক্ষত বা শারিরীক দূর্বলতার জন্য আর্সেনিক ঔষধ খাওয়া জরুরি।
এনরোসিন (Enrocine)
হাঁসের চোখের সমস্যার ব্যবহৃত হয়। হাঁসের কুজো হয়ে হাঁটা, ঝিমানোর, থলি ফুলে যাওয়ার জন্য ৩-৫ দিন দুবেলা খাওয়ানো অবশ্যক।
এনরোফ্লক্সোসিন (Enrofloxine)
হাঁসের চোখের মুখ দিয়ে লালা পড়ার প্রতিষেধক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। হাঁসের পাতলা ও চুনা পায়খানা, সর্দি-কাশি, নাকে ও গলায় জমা কফের প্রতিষেধক হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। হাঁসের চোখ ঘোলা হয়ে গেলেও এই ঔষধে কাজ হবে।
সিপ্রোফ্লক্সাসিন (Siproflaxine)
হাঁসের জ্বর হলে এই সিরাপ ৩-৫ দিন খাওয়াতে হবে।
আ্যলবেন্ডাজল (Albendazol)
কৃমিনাশক হিসেবে খাওয়ানো হয় হাঁস কে। হাঁসের কৃমি জনিত ঔষধ হিসেবে কৃমিনাশক নির্দিষ্ট ৩৫-৪০ দিন পরপর ব্যবহার করা যেতে পারে।
জি-সিরাফ (G-Syrup)
হাঁসের মাথার চুল উঠে গেলে খাওয়াতে হবে।
সেপ্ট্রা (Septra)
হাঁস হাঁটা-চলা ও ভালো করে খাবার না খেলে খাওয়াতে হবে।
অ্যামোক্সাসালিন (Amoxicillin)
হাঁসের আমাশয়, সর্দির জন্য ৩ দিন ১ লিটার পানিতে ১ গ্রাম করে খাওয়াতে হবে।
সালফামেজাথিন (৩৩%) (Sulphamezathine-33%)
হাঁসের ডাক কলেরা হয়ে গেলে সালফামেজাথিন ৩৩% কয়েক চামচ ১ মিলি পানিতে খাওয়াতে হবে।
অক্সিটেট্রাসাইক্লিন (Oxytetracycline)
টিকা দেওয়ার পরও হাঁস ডাক প্লেগ রোগে আক্রান্ত হল অক্সিটেট্রাসাইক্লিন ট্যাবলেট 250/500 mg ট্যাবলেট ৪/৮ ভাগ করে ৩-৫ দিন প্রতি ২ বেলা খাওয়ানো আবশ্যক।
এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা (Avian Influenza)
হাঁসের খামারে এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা সনাক্ত হলে সমস্ত খামারের হাঁস কে বিনষ্ট বা হত্যা করে সঠিকভাবে সৎকার করতে হবে।
তুঁতে
হাঁষের ব্রুডার নিউমোনিয়া সনাক্ত হলে হাঁস কে তুঁতে দিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা নিতে হবে।
এন্টিবায়োটিক(Antibiotics)
হাঁসের সেপ্টিসেমিয়ার জন্য ভেটেরেনোরিয়ান দ্বারা এন্টিবায়োটিক প্রতিষেধক গ্রহণ করতে হবে।
এন্টিটক্সিন(Antitoxin)
হাঁসের মাইকোটক্সিকোসিসের চিকিৎসায় চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে এন্টিটক্সিন, টক্সিন বাইন্ডারের মাধ্যমে চিকিৎসা নিতে হবে।
স্যালাইন (Saline)
হাঁসের বক্টুলিজমের জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে স্যালাইন ও চিটাগুড় নির্দিষ্ট হারে প্রয়োগ করলে সুস্থ করা যায় হাঁস কে।
বহুল জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন-উত্তর সমূহ
হাঁসের ঔষধ তালিকা এই বিষয়ে আপনার মনে বেশ কয়েকটি প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে? তাহলে চলুন জেনে নেই সেই সকল প্রশ্ন ও উত্তর।
হাঁসের অপুষ্টি জনিত রোগ কোন গুলো?
প্যারালাইসিস, দূর্বলতা, রাতকানা, রিকেট হচ্ছে হাঁসের অপুষ্টিজনিত রোগ।
হাঁসের চিকিৎসা শুধুমাত্র এই উল্লেখিত ঔষধ দ্বারা করলেই কী চলবে?
হাঁসের চিকিৎসার জন্য এই ঔষধ গুলো ব্যবহার করতে পারেন। কিন্তু সবচেয়ে ভালো হয় একজন চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করা।
উপসংহার
উপরোক্ত বিস্তারিত আলোচনা থেকে আমরা হাঁসের ঔষধ তালিকা, টিকা ও বিভিন্ন রোগ সম্বন্ধে বিস্তারিত জেনেছি। হাঁস আমাদের দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রাণিসম্পদ। তাই হাঁস সঠিকভাবে পালন করতে হাঁসের ঔষধ তালিকা ও হাঁস পালনের পদ্ধতি সম্বন্ধে সুস্পষ্ট ধারণা থাকা প্রয়োজন।
হাঁস পালন করে আমাদের দেশের মানুষের আমিষের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতেও হাঁস পালন কার্যকরী অবদান রাখে। এছাড়াও আপনার জ্ঞানকে প্রসারিত করতে গরু মোটাতাজাকরণ দানাদার খাদ্য তালিকা সম্পর্কে পড়তে পারেন।
“হাঁসের ঔষধ তালিকা” এ বিষয়ে আপনার যদি কিছু জানার থাকে তবে আপনি এই পোস্টের নিচে মন্তব্য করতে পারেন। এছাড়াও এই পোস্ট-টি তথ্যবহুল মনে হলে আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ!
অনেক ভালো লাগলো