কোন জাতের ছাগল পালনে লাভ বেশি এটা নতুন পুরাতন যেকোনো ছাগল খামারিদের একটি কমন প্রশ্ন। আর তাই আপনি যদি বাংলাদেশে ছাগল পালনের ব্যবসা শুরু করতে চান তবে আপনাকে অবশ্যই আপনার খামারের জন্য সেরা জাতের ছাগল সংগ্রহ করতে হবে।
কেননা আমাদের দেশে ছাগল পালন ধীরে ধীরে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। যদিও এটি একটি প্রতিষ্ঠিত ব্যবসা, তাই অনেকে বাণিজ্যিকভাবে ছাগল পালনের কথা ভাবছেন। ছাগলের দুধ ও মাংসের শুধু দেশীয় চাহিদাই নয়, আন্তর্জাতিক বাজারেও এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।
এ কারণেই নিবিড় বা আধা-নিবিড় পদ্ধতিতে বাণিজ্যিক ছাগল পালন গত কয়েক বছর ধরে এর উচ্চ চাহিদা এবং ভালো অর্থনৈতিক সম্ভাবনার কারণে গতি পাচ্ছে। তদুপরি, ছাগলের উদ্যোগকে বাণিজ্যিকভাবে এগিয়ে নেওয়ার জন্য, বাণিজ্যিক ছাগল পালনে অনেক আধুনিক খামারি, পেশাজীবী, প্রাক্তন সেনা, বেকার শিক্ষিত যুবক এবং বিখ্যাত ব্যবসায়ী তৈরি হচ্ছে।
কেন উন্নত জাতের ছাগল পালন করা উচিৎ?

যেহেতু ছাগলের দুধ অন্যান্য ধরনের দুধের তুলনায় কম ল্যাকটোজ থাকে, তাই ল্যাকটোজ অসহিষ্ণুতায় ভোগা লোকেদের জন্য এটি হজম করা সহজ। এছাড়াও, অনেক লোক আছেন যারা সালাদে বা স্যান্ডউইচে ভাল ছাগলের পনির পছন্দ করেন। যাইহোক বাংলাদেশে ছাগলের মাংসের চাহিদা যথেষ্ট বেশী।
ছাগল পালনের উদ্দেশ্য

আমরা যারা খামারি আছি তারা দুটি উদ্দেশ্যে ছাগল পালন করে থাকি। যার একটি হলো দুধ উৎপাদন, অন্যটি হলো মাংস উৎপাদন। তাই ছাগল পালনের সময় আমরা যারা শুধু দুধ উৎপাদন করতে চায়, তারা ভালো দুধ উৎপাদন করে এমন জাতের ছাগল পালন করতে হবে, যা ভালো উৎপাদন করতে পারে।
একইসাথে যারা শুধু মাংস উৎপাদন করতে চায়, তাদের উচিত হবে ভালো জাতের মাংস উৎপাদনকারী ছাগল পালনের। আসুন এবার জেনে নেই, বাংলাদেশে সবচেয়ে জনপ্রিয় ছাগলের জাতগুলো কোনগুলো এবং তাদের বৈশিষ্ট্যগুলো কি কি সেটি সম্পর্কে।
কোন জাতের ছাগল পালনে লাভ বেশি?
আমরা অনেকেই নিজেদের বাড়িতে ছাগল পালন করি। কোন জাতের ছাগল পালনে লাভ বেশি এ সম্পর্কে অনেকেই জানিনা। নিচে উন্নত জাতের ছাগল সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরা হল-
১. বোয়ার ছাগল

বোয়ার্স মাংসের জন্য সেরা একটি জাত। এদের পুরুষরা ৩৯৯ পাউন্ড পর্যন্ত হতে পারে। সুতরাং, এই বড় আকারের কারণে তারা মাংস উৎপাদনের জন্য সবচেয়ে জনপ্রিয় জাতগুলির মধ্যে একটি।
এর অন্যান্য সুবিধার মধ্যে, এটি একটি সেরা ছাগলের জাত যারা রোগ প্রতিরোধী এবং প্রায়শই প্রজনন করে। অস্ট্রেলিয়া এই বোয়ার ছাগল ব্যবহার করে তারা ছাগলের মাংসের শীর্ষ রপ্তানিকারক। এইজন্য যারা মাংস উৎপাদনের উদ্দেশ্যে সেরা ছাগলের জাত খুঁজছেন তাদের জন্য বোয়ার্স হচ্ছে সেরা একটি পছন্দ।
২. ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল

বাংলাদেশে ২৫ মিলিয়নের বেশী ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল পালন করা হয়। আমাদের দেশের লোকেরা ব্ল্যাক বেঙ্গল এর দুধ এবং মাংস দিয়ে নিজেদের ভরণপোষণের উপায় খুঁজে থাকেন। এই ছাগলের জাত বিহার, উড়িষ্যা এবং পশ্চিমবঙ্গেও পাওয়া যায়। এটি প্রধানত কালো রঙের হয়। এছাড়াও এটি বাদামী, সাদা এবং ধূসর রঙে পাওয়া যায়। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এটি কালো রঙের হয়।
এটি চাষ করা খুবই সহজ কারণ এই ছাগলগুলির যত্ন নেওয়া, ঘর করা এবং খাওয়ানো তুলনামূলকভাবে সহজ। এমনকি এরা প্রাকৃতিক উৎস থেকে খাবার খেয়ে থাকে এবং বছরে দুবারে ২ -৩টি বাচ্চার জন্ম দিতে পারে। একইসাথে এরা ভাল প্রজননকারী হিসাবে, ব্ল্যাক বেঙ্গল প্রায় ১৫ মাস বয়সে প্রজনন শুরু করে। এই জাতের ছাগল মাংস উৎপাদনের জন্য ভালো বলে মনে করা হয়। এই জাতের ছাগলের দুধ উৎপাদন ক্ষমতা কিছুটা কম। এই প্রজাতির পুরুষ ছাগলের ওজন ২৫-৩৯ কেজি এবং স্ত্রী ছাগলের ওজন ২৯-২৫ কেজি। এই জাতটি প্রথম দিকে প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে ওঠে এবং প্রতিটি স্তন্যদানে ২-৩টি বাচ্চার জন্ম দেয়।
৩. কালাহারি ছাগল

কালাহারি সম্পর্কে সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, এটির মাংস অন্যান্য জাতের তুলনায় নরম আর এই ছাগলগুলো টেকসই হওয়ায় এসব ছাগলের প্রজনন ভালো হয়। এরা এলাকার সাধারণ রোগ এবং পরজীবীগুলির বিরুদ্ধে ভাল লড়াই করে। একইসাথে তাদের বৃহত্তর প্রজাতির সাথে প্রজনন করা হয় বলে তাদের শরীর মাংসল হয়।
৪. যমুনাপারি ছাগল

ছাগলের এই জাতটি উত্তরপ্রদেশের মথুরা, ইটাওয়া এবং এর আশেপাশের এলাকায় পাওয়া যায়। আমাদের দেশে এর উৎপাদন খুবই ভালো। সাধারণত এই ছাগলের রং সাদা এবং মুখে হালকা হলুদ এবং ঘাড় ও মুখে হালকা গাঢ় বাদামী দাগ থাকে। এ ছাড়া এ প্রজাতির কিছু ছাগলের শরীরে গাঢ় বা কালো রঙের দাগও দেখা যায়।
এটি দুধ এবং মাংস উভয়ের জন্যই উত্তম বলে বিবেচিত হয়। এটি ছাগলের সেরা জাত বলা হয়। এর প্রাপ্তবয়স্ক ছাগলের গড় শরীরের ওজন 5৫ থেকে 8৫ কেজি, যেখানে ছাগলের ওজন ৪৫ থেকে 5১ কেজি পর্যন্ত হয়। এর পুরুষ ছাগলের দাড়ি আছে।
সাধারণত, এই প্রজাতির ছাগল একবার বাছুর এবং ৫৭ শতাংশ একটি একক বাচ্চা দেয়। যেখানে ৪৩ শতাংশ ক্ষেত্রে এই প্রজাতির ছাগল যমজ সন্তানের জন্ম দেয়। লম্বা কান বিশিষ্ট এই ছাগল প্রতিদিন গড়ে ১.৫ থেকে ২.০ কেজি। এর গড় দুধ উৎপাদন গাভী প্রতি ২৯৯ কেজি।
৫. বারবারি ছাগল

এই জাতের ছাগল প্রধানত পাঞ্জাব, রাজস্থান, আগ্রা এবং ইউপি জেলায় পাওয়া যায়। তবে ধীরে ধীরে আমাদের দেশেও এই জাতের ছাগলের উৎপাদন বাড়ছে। এই প্রজাতির ছাগলের উচ্চতা মাঝারি। এর শরীর ঘন ও এর কান ছোট এবং চ্যাপ্টা। এই প্রজাতির পুরুষ ছাগলের ওজন ৩8-৪৯ কেজি এবং স্ত্রী ছাগলের ওজন ২৩-২৫ কেজি।
পুরুষ ছাগলের দৈর্ঘ্য প্রায় 5৫ সেমি। এবং স্ত্রী ছাগলের দৈর্ঘ্য প্রায় ৭৫ সেমি। সাধারণত এই জাতের ছাগলের শরীরে সাদা রঙের সাথে ছোট ছোট হালকা বাদামী দাগ দেখা যায়। পুরুষ ছাগল এবং স্ত্রী বারবারী ছাগল উভয়েরই খুব ঘন দাড়ি থাকে। এই প্রজাতির ছাগল প্রতিদিন ১.৫-২.৯ কেজি এবং স্তন্যপান করানোর সময় ১৪৯ কেজি দুধ দেয়।
৬. কারি বিটল ছাগল

এই জাতটি বেশিরভাগ পাঞ্জাব এবং হরিয়ানা রাজ্যে পাওয়া যায়। যা আমাদের দেশেও এখন ব্যাপকভাবে পালন করা হচ্ছে। কারি বিটল ছাগল মূলত মাংস ও দুগ্ধজাত খাবারের জন্য লালন-পালন করা হয়। এই জাতের ছাগলের পা লম্বা। এর কান ঝুলে আছে। এর লেজ ছোট ও পাতলা। এর শিং বাঁকা। এর পুরুষ ছাগলের ওজন ৫৯-5৯ কেজি। যেখানে স্ত্রী ছাগলের ওজন ৩৫-৪০ কেজি। পুরুষ ছাগলের দেহের দৈর্ঘ্য প্রায় 85 সেমি। এবং স্ত্রী ছাগলের দেহের দৈর্ঘ্য প্রায় ৭১ সেন্টিমিটার। এই জাতের স্ত্রী ছাগল প্রতিদিন গড়ে ২.৯-২.২৫ কেজি দুধ দেয়।
৭. সিরোহি ছাগল

এই জাতের ছাগল প্রায়ই গুজরাটের পালমপুর এবং রাজস্থানের সিরোহি জেলায় পাওয়া যায়। এই ছাগলও আমাদের দেশে এখন ভালো চাষ করা হচ্ছে। এরা আকার ছোট। এই জাতের ছাগলের শরীর বাদামী এবং শরীরে হালকা বাদামী দাগ থাকে। এর কান চ্যাপ্টা এবং ঝুলন্ত। এর শিং ছোট ও বাঁকা। এর চুল ঘন। এর প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ ছাগলের ওজন ৫৯ কেজি এবং বয়স্ক ছাগলের ওজন ৪৯ কেজি। এর পুরুষ ছাগলের দৈর্ঘ্য প্রায় 8৯ সেমি এবং স্ত্রী ছাগলের দৈর্ঘ্য প্রায় 5২ সেমি। এই প্রজাতির ছাগল প্রতিদিন গড়ে ০.৫ কেজি এবং প্রতি বাছুর গড়ে ৬৫ কেজি দুধ দেয়। একটি ছাগল সাধারণত দুটি বাচ্চা প্রসব করে।
৮. সানেন ছাগল

সানেন ছাগলের উৎপত্তি সুইজারল্যান্ডের সানেন উপত্যকায়। এটি সবচেয়ে জনপ্রিয় দুগ্ধজাত ছাগল যা দিনে উচ্চ মানের দুধ উৎপাদন করে। বাণিজ্যিকভাবে ছাগল পালনের জন্য, সানেন ছাগল পালন খুবই লাভজনক। ছোট আকারে ছাগল পালন ব্যবসা শুরু করার জন্য সানেন ছাগলের জাত একটি ভাল আদর্শ হতে পারে।
৯. বিতাল ছাগল

বিতাল ছাগলের জাতটি পাঞ্জাবে উৎপত্তি হলেও পাকিস্তানেও বেড়ে ওঠে। যা আমাদের দেশেও খুব ভালোভাবে পালন করা হচ্ছে। এই ছাগলগুলি আকারে ছোট কিন্তু একটি প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের ওজন ৪৫ থেকে 5৫ কেজি এবং একটি প্রাপ্তবয়স্ক মহিলার ৩৫ থেকে ৪৫ কেজি পর্যন্ত হয়। এগুলি মাংস এবং দুধ উভয়ের জন্যই আদর্শ।
বহুল জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন-উত্তর সমূহ
কোন জাতের ছাগল পালনে লাভ বেশি এই বিষয়ে আপনার মনে বেশ কয়েকটি প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে? তাহলে চলুন জেনে নেই সেই সকল প্রশ্ন ও উত্তর।
ছাগলের স্বভাব কি?
ছাগল চটপটে এবং ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে খাদ্য আরোহণ এবং ভারসাম্য রক্ষার দক্ষতার জন্য বেশ সুপরিচিত। অর্থাৎ এরা খুবই অস্থির প্রকৃতির হয়। এমনকি এদের চরিত্র এমন যে, কখনো সটান গাছে উঠে যাচ্ছে আবার কখনো মাঠে ময়দানে নিজের মতোই দৌড়াদৌড়ি করছে। যাইহোক এরা খুবই নম্র ও ভদ্র স্বভাবের
হয়ে থাকে।
ছাগলের দুধের উপকারিতা কী?
ছাগলের দুধ পান করার অনেক উপকারিতা রয়েছে, যার মধ্যে কয়েকটি হল এতে ক্যালসিয়াম এবং ভিটামিন এ বেশি থাকে এবং গরুর দুধের তুলনায় মানবদেহ ছাগলের দুধ সহজেই হজম করতে পারে।
উপসংহার
কোন জাতের ছাগল পালনে লাভ বেশি এটা আশাকরি আপনাদের সামনে পরিষ্কার হয়ে গেছে। আমাদের দেশে দেশীয় ছাগলের পাশাপাশি ব্যাপকভাবে বিদেশী ছাগল পালন করে আসছে খামারিরা। এতে তারা বেশ লাভবান হচ্ছে। তাই এইসব বিদেশী ছাগলের জাত লালন পালন করলে আশাকরি খুবই লাভজনজ। এছাড়াও আপনার জ্ঞানকে প্রসারিত করতে “কোন গরু পালনে লাভ বেশি” এ সম্পর্কে পড়তে পারেন।
“কোন জাতের ছাগল পালনে লাভ বেশি” এ বিষয়ে আপনার যদি কিছু জানার থাকে তবে আপনি এই পোস্টের নিচে মন্তব্য করতে পারেন। এছাড়াও এই পোস্ট-টি তথ্যবহুল মনে হলে আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ!