দিনাজপুর কিসের জন্য বিখ্যাত তা বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসেবে আপনার কিন্তু জানা জরুরী। কি বলেন, আমি ঠিক বলছি তো? আপনি যদি দিনাজপুর জেলার বিখ্যাত হওয়ার কারণ না জেনে থাকেন তবে দুশ্চিন্তা না করে এই পোস্টটি অত্যন্ত মনোযোগসহ পড়তে থাকুন। কেননা, এই পোস্টে আমরা দিনাজপুর জেলা সম্পর্কে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য, বিখ্যাত খাবার, দর্শনীয় স্থান নিয়ে আলোচনা করবো।
দিনাজপুর কিসের জন্য বিখ্যাত
বাংলাদেশের অন্যতম এবং সমৃদ্ধ জেলা দিনাজপুর বিখ্যাত হওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে সেখানে থাকা শত শত দর্শনীয় স্থান, বিখ্যাত সব খাবার, মানুষের সহজ সরলতা অনবদ্য ভূমিকা রেখেছে। দিনাজপুর কিসের জন্য বিখ্যাত আজকের পোস্টে আমরা এই বিষয়েরই খুঁটিনাটি জানবো।
দিনাজপুর জেলা সম্পর্কে কিছু তথ্য
দিনাজপুর জেলা বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের রংপুর বিভাগের একটি অন্যতম প্রাচীন ও বৃহৎ জেলা। উপজেলার সংখ্যানুসারে দিনাজপুর বাংলাদেশের একটি “এ” শ্রেণীভুক্ত জেলা। দিনাজপুর জেলা আয়তনে উত্তরবঙ্গের ১৬টি জেলার মধ্যে বৃহত্তম।
ভৌগোলিক অবস্থান
দিনাজপুর জেলার ভৌগোলিক অবস্থান ২৪°০০′ উত্তর অক্ষাংশ থেকে ২৫°৩৬′ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৮°০০′ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ থেকে ৮৯°০০′ পূর্ব দ্রাঘিমাংশের মধ্যে। জেলার দক্ষিণে নীলফামারী জেলা, পশ্চিমে রংপুর ও পঞ্চগড় জেলা, উত্তরে ভারতের মালদহ ও জলপাইগুড়ি জেলা এবং পূর্বে ঠাকুরগাঁও ও বগুড়া জেলা অবস্থিত।
আয়তন ও জনসংখ্যা
দিনাজপুর জেলার আয়তন ৩,৪৪৪ বর্গকিলোমিটার। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী দিনাজপুর জেলার মোট জনসংখ্যা ২,৯২৮,০০০ জন। এর মধ্যে পুরুষ ১,৪৫০,০০০ জন এবং মহিলা ১,৪৭৮,০০০ জন।
দিনাজপুরের বিখ্যাত খাবার
দিনাজপুরের খাবার তার নিজস্ব অনন্য স্বাদের জন্য বিখ্যাত। দিনাজপুরের বিখ্যাত খাবারের মধ্যে রয়েছে-
সিদল
সিদল হলো এক ধরনের ঐতিহ্যবাহী খাবার যা দিনাজপুরের নিজস্ব। সিদল তৈরি হয় ভেড়ার মাংস, পেঁয়াজ, মরিচ, ধনেপাতা, জিরা, গরম মশলা ইত্যাদি দিয়ে। সিদল সাধারণত ভাত, রুটি বা পরোটার সাথে পরিবেশন করা হয়।
বুট বিরিয়ানি
বুট বিরিয়ানি হলো আরেকটি জনপ্রিয় খাবার যা দিনাজপুরের নিজস্ব। বুট বিরিয়ানি তৈরি হয় বুট, ভেড়ার মাংস, পেঁয়াজ, মরিচ, ধনেপাতা, জিরা, গরম মশলা ইত্যাদি দিয়ে। বুট বিরিয়ানি সাধারণত ভাত, রুটি বা পরোটার সাথে পরিবেশন করা হয়।
মহাজনি মিষ্টি পোলাও
মহাজনী মিষ্টি পোলাও হলো দিনাজপুরের একটি ঐতিহ্যবাহী খাবার যা মহাজনী সম্প্রদায়ের লোকেরা তৈরি করে। মহাজনী মিষ্টি পোলাও তৈরি হয় চাল, ভেড়ার মাংস, পেঁয়াজ, মরিচ, ধনেপাতা, জিরা, গরম মশলা, চিনি, এলাচ, দারুচিনি, জায়ফল, জয়ত্রী ইত্যাদি দিয়ে। মহাজনী মিষ্টি পোলাও সাধারণত ভাত, রুটি বা পরোটার সাথে পরিবেশন করা হয়।
প্যালকা
প্যালকা হলো দিনাজপুরের একটি ঐতিহ্যবাহী খাবার যা সাধারণত গ্রামাঞ্চলে তৈরি করা হয়। প্যালকা তৈরি হয় বিভিন্ন ধরনের শাক দিয়ে। প্যালকা সাধারণত ভাত, রুটি বা পরোটার সাথে পরিবেশন করা হয়।
সিদল ভর্তা
সিদল ভর্তা হলো সিদল দিয়ে তৈরি একটি জনপ্রিয় ভর্তা। সিদল ভর্তা তৈরি হয় সিদল, পেঁয়াজ, মরিচ, ধনেপাতা, জিরা, গরম মশলা ইত্যাদি দিয়ে। সিদল ভর্তা সাধারণত ভাত, রুটি বা পরোটার সাথে পরিবেশন করা হয়।
পাপড়
দিনাজপুরের পাপড় পুরো বাংলাদেশে বিখ্যাত। দিনাজপুরের পাপড় তৈরি হয় বিশেষ পদ্ধতিতে। দিনাজপুরের পাপড়ের স্বাদ ও গুণমান অন্য পাপড়ের তুলনায় অনেক বেশি।
এছাড়াও, দিনাজপুরের অন্যান্য বিখ্যাত খাবারের মধ্যে রয়েছে: রসুন দিয়ে মাংস, আলুর ডাল দিয়ে ডিম, শুটকি দিয়ে চামঘাস ও সরিষা ফুল দিয়ে ডিম ভাজা অন্যতম। দিনাজপুরের খাবার তার নিজস্ব অনন্য স্বাদের জন্য দেশ-বিদেশে পরিচিত। দিনাজপুরে গেলে অবশ্যই এই বিখ্যাত খাবারগুলো চেখে দেখবেন।
দিনাজপুরের বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গ
- হাজী মোহাম্মদ দানেশ – অবিভক্ত ব্রিটিশ ভারতের কৃষক নেতা। তাঁর নামানুসারে হাজী মোহাম্মাদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়।
- অধ্যাপক ইউসুফ আলী – তিনি ছিলেন, বাংলাদেশের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী, স্বাধীনতার সনদ পাঠক ও মুজিবনগর সরকারের ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী।
- এম আব্দুর রহিম – তিনি ছিলেন, স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, সংবিধান রচনাকারী ও সাবেক সংসদ সদস্য। তাঁর নামকে স্বরণীয় করতেই দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ এর নাম পরিবর্তন করে এম. আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজ করা হয়।
- সুভাষ দত্ত – একাধারে তিনি বাংলাদেশি চলচ্চিত্রশিল্পী, নির্মাতা ও অভিনেতা হিসেবে সর্বজন স্বীকৃত।
- বিচারপতি এ. টি. এম. আফজাল – তিনি ছিলেন বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত আইনবিদ ও সেই সাথে ৮ ম প্রধান বিচারপতি।
- নিতুন কুন্ডু – বাংলাদেশি চিত্রশিল্পী, ভাস্কর, মুক্তিযোদ্ধা ও ব্যবসায়ী হিসেবে তাঁর জুড়ি মেলা ভার।
- আবুল হাসান মাহমুদ আলী – তিনি ছিলেন সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী। দিনাজপুরের বিখ্যাত ব্যক্তিদের তালিকায় তাঁর নাম অগ্রগণ্য।
- আব্দুল্লাহ আল কাফি – তিনি একজন বাংলাদেশি রাজনীতিবিদ ও শিক্ষাবিদ, সাবেক সংসদ সদস্য, দিনাজপুর-১।
- খালেদা জিয়া – আমাদের দেশের সাবেক ও প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী হলেন বেগম খালেদা জিয়া।
- মোস্তাফিজুর রহমান ফিজার – তিনি ছিলেন বাংলাদেশের দিনাজপুর-৫ আসনের সংসদ সদস্য।
- ডা. মোহাম্মদ আমজাদ হোসেন – স্বনামধন্য ব্যক্তি, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা, স্বাধীনতা পদক প্রাপ্ত সমাজ সেবক ও একইসাথে দেশসেরা অর্থোপেডিক চিকিৎসক হচ্ছেন তিনি।
- শহীদ ক্যাপ্টেন মাহবুবুর রহমান – ১৯৭১-এ শহীদ মুক্তিযোদ্ধা।
- এ,এল,এম ফজলুর রহমান – তিনি একজন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা এবং বাংলাদেশ রাইফেলসের সাবেক মহাপরিচালক ছিলেন।
- মনোরঞ্জন শীল গোপাল – তিনি হচ্ছেন, বাংলাদেশের দিনাজপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য।
- ইকবালুর রহিম – জনাব এম. আব্দুর রহিম এর পুত্র হলেন ইকবালুর রহিম যিনি বাংলাদেশের দিনাজপুর-৩ আসনের সংসদ সদস্য।
- মিজানুর রহমান মানু – বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ।
- জাকিয়া তাবাসসুম – একাদশ জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত নারী আসনের সাংসদ হিসেবে দায়িত্ব পালন করা বিশিষ্ট মহিলা।
- শিবলী সাদিক – নবাবগঞ্জে জন্মগ্রহণকারী বাংলাদেশের একজন রাজনীতিবিদ ও সংসদ সদস্য দিনাজপুর-৬।
- ধীমান ঘোষ – বাংলাদেশি ক্রিকেটার।
দিনাজপুরের দর্শনীয় স্থান
দিনাজপুর জেলা বাংলাদেশের একটি প্রাচীন ও সমৃদ্ধ জেলা। জেলাটি তার সমৃদ্ধ ইতিহাস, গর্বিত ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির জন্য বিখ্যাত। দিনাজপুরের বেশ কিছু দর্শনীয় স্থান রয়েছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-
শাহ মখদুম রুপোশের মাজার
দিনাজপুরের অন্যতম বিখ্যাত দর্শনীয় স্থান হলো শাহ মখদুম রুপোশের মাজার। তিনি একজন সুফি সাধক ছিলেন যিনি ১৪শ শতাব্দীতে দিনাজপুরে এসেছিলেন। তার মাজারটি দিনাজপুর শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত।
শাহ সুলতান আহমেদ খানের মাজার
শাহ মখদুম রুপোশের একজন শিষ্য ছিলেন শাহ সুলতান আহমেদ খান। তিনি ১৫শ শতাব্দীতে দিনাজপুরে আসেন এবং এখানেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তার মাজারটি দিনাজপুর শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত।
কান্তজিউ মন্দির
কান্তজিউ মন্দির বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় স্থাপনা। এটি বাংলাদেশের জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে স্বীকৃত। কান্তজিউ মন্দিরটি দিনাজপুর শহর থেকে ২০ কিলোমিটার উত্তরে এবং দিনাজপুর-তেতঁলিয়া মহাসড়কের পশ্চিমে ঢেঁপা নদীর তীরে অবস্থিত। মন্দিরটি ১৭০৪ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন দিনাজপুরের মহারাজা জমিদার প্রাণনাথ রায় তার শেষ বয়সে নির্মাণ কাজ শুরু করেন।
রামসাগর
দিনাজপুরের অন্যতম বিখ্যাত দর্শনীয় স্থান হলো রামসাগর। এটি একটি কৃত্রিম দিঘি যা পলাশী বিপ্লবের কিছু পূর্বে রাজা রামনাথ খনন করেছিলেন। রামসাগরের আয়তন প্রায় ৪৩৭,৪৯২ বর্গমিটার।
শিশুপার্ক
দিনাজপুর শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত শিশুপার্কটি একটি জনপ্রিয় বিনোদন কেন্দ্র। এখানে শিশুদের জন্য বিভিন্ন ধরনের খেলার সরঞ্জাম রয়েছে।
গোর-এ-শহীদ
দিনাজপুরের অন্যতম ঐতিহাসিক স্থান হলো গোর-এ-শহীদ। এটি ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহে শহীদ হওয়া শহীদদের সমাধি।
মহারাজা দীঘি
দিনাজপুর শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত মহারাজা দীঘি একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা। এটি ১৯শ শতাব্দীতে নির্মিত হয়েছিল। মহারাজা দীঘির আয়তন প্রায় ৩,০০০ বর্গমিটার।
এছাড়াও, দিনাজপুরে অন্যান্য দর্শনীয় স্থান এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:- স্বপ্নপুরী পিকনিক স্পট। কখনো, দিনাজপুরে গেলে অবশ্যই এই দর্শনীয় স্থানগুলি ঘুরে দেখবেন।
বহুল জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন-উত্তর সমূহ
উত্তরবঙ্গের জনপ্রিয় জেলা দিনাজপুর কিসের জন্য বিখ্যাত তার সম্যক ধারণা এতক্ষনে পাওয়ার কথা। দিনাজপুর কিসের জন্য বিখ্যাত এ সম্পর্কে জানার পরও নিশ্চয় আরও কিছু প্রশ্ন হয়তো আপনার মনে উঁকি দিচ্ছে। আসুন জেনে নেওয়া যাক সেই সকল প্রশ্ন এবং উত্তরসমূহ-
দিনাজপুরের অবস্থান কোথায়?
দিনাজপুর জেলা বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের রংপুর বিভাগের একটি জেলা। এটি ২৪°০০′ উত্তর অক্ষাংশ থেকে ২৫°৩৬′ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৮°০০′ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ থেকে ৮৯°০০′ পূর্ব দ্রাঘিমাংশের মধ্যে অবস্থিত।
দিনাজপুরের আয়তন কত?
দিনাজপুর জেলার আয়তন ৩,৪৪৪ বর্গকিলোমিটার।
দিনাজপুরের জনসংখ্যা কত?
২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী দিনাজপুর জেলার মোট জনসংখ্যা ২৬,৪২,৮৫০ জন। তাদের মধ্যে, পুরুষ ১৩,৬৩,৮৯২ জন ও মহিলা ১২,৭৮,৯৫৮ জন।
দিনাজপুরের প্রধান নদী কোনটি?
দিনাজপুরের অনেকগুলো নদী এর মধ্যে প্রধান নদী হলো পুনর্ভবা নদী।
দিনাজপুরের প্রধান খাবার কোনটি?
দিনাজপুরের প্রধান খাবার হলো সিদল, বুট বিরিয়ানি, মহাজনী মিষ্টি পোলাও, প্যালকা, সিদল ভর্তা, পাপড় ইত্যাদি।
দিনাজপুরের লোকসংস্কৃতি কীরকম?
দিনাজপুরের লোকসংস্কৃতি অত্যন্ত সমৃদ্ধ। দিনাজপুরের লোকসংস্কৃতির মধ্যে রয়েছে লোকগীতি, লোকনাট্য, লোকশিল্প, লোকজ উৎসব ইত্যাদি।
উপসংহার
প্রিয় পাঠক, আপনি কি জানেন বাংলাদেশের মধ্যে সবথেকে সহজ সরল মনের মানুষ কোথায় পাওয়া যায়? আপনি কখনো দিনাজপুর গেলেই বুঝতে পারবেন সেখানের মানুষগুলো কতটা সাদাসিধে। সত্যিকার অর্থেই এই জেলার মানুষ অন্যান্য জেলার তুলনায় বেশি উদার। অন্য জেলাকে হেয় করার উদ্দেশ্যে বলছি না, তাই দয়া করে কেউ মনে কষ্ট নিবেন না। এছাড়াও আপনার জ্ঞানকে প্রসারিত করতে মানিকগঞ্জ কিসের জন্য বিখ্যাত এ সম্পর্কে পড়তে পারেন।
তাহলে ‘দিনাজপুর কিসের জন্য বিখ্যাত ‘পুরো পোস্ট পড়ার পর নিশ্চয় বুঝতে পারছেন। আপনাদের সুস্বাস্থ্য কামণা করে আজকের মত বিদায় নিচ্ছি। আল্লাহ হাফেজ।