২১ শে ফেব্রুয়ারি নিয়ে কিছু কথা যা জানা আমাদের প্রত্যেকের জন্য অত্যাবশকীয়। কেননা এই দিনে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ঢাকায় আন্দোলন হয় আর সেখানে আন্দোলন করা শিক্ষার্থীদের উপর মারাত্মক গুলিবর্ষণ হয়। ঘটনাস্থালেই প্রাণ যায় রফিক, শফিক, বরকত জব্বার ও আরো অনেক মেধাবী তরুণের। শত শত প্রাণের বিনিময়ে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পায় বাংলা ভাষা । তারপর থেকেই প্রতি বছর ২১ শে ফ্রেব্রুয়ারী পালন করা হয়। চলুন আজকে একুশে ফেব্রুয়ারি নিয়ে বিস্তারিত তথ্য জানা যাক।
২১ শে ফেব্রুয়ারি নিয়ে কিছু কথা
২১ শে ফেব্রুয়ারি মানে একদল মেধাবী ছাত্রের আত্মহনন। ২১ শে ফেব্রুয়ারি মানে শত মায়ের বুক খালি করা আর্তনাদ। ২১ শে ফেব্রুয়ারি মানে ভাষার জন্য জীবন দেওয়ার এক আলাদা চেতনা। ২১ শে ফেব্রুয়ারি নিয়ে কিছু কথা জানতে পড়া চালিয়ে যান। গোটা বিশ্বে ভাষার জন্য জীবন দেওয়ার এক অনন্য ইতিহাস রচনা করেছেন এদেশের শত শত তরুন।
২১ শে ফেব্রুয়ারি কি?

২১ শে ফেব্রুয়ারি হল বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় দিবস। এটি বাংলা ভাষার জন্য আন্দোলনে শহীদদের স্মরণে পালিত হয়। ১৯৫২ সালের এই দিনে ঢাকায় ছাত্র-জনতার মিছিলে পুলিশ গুলি চালালে সালাম, রফিক, বরকত, জব্বারসহ কয়েকজন শহীদ হন। তাদের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়। ২১ শে ফেব্রুয়ারি শুধুমাত্র একটি জাতীয় দিবসই নয়, এটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসও বটে। ১৯৯৯ সালে জাতিসংঘ এই দিনটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। প্রতিবছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই দিবসটি পালিত হয়।
২১ শে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পালিত হয়। এদিন বাংলাদেশের সকল সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন বিভিন্ন কর্মসূচির আয়োজন করে। শহীদ মিনারে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ, আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, প্রভাত ফেরী, র্যালি, পথনাটক, বিতর্ক প্রতিযোগিতা ইত্যাদি কর্মসূচির মাধ্যমে এই দিনটি পালিত হয়। ২১ শে ফেব্রুয়ারি আমাদেরকে মাতৃভাষার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করে। আমাদেরকে শিক্ষা দেয় যে, মাতৃভাষা আমাদের জাতীয় পরিচয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষা করা আমাদের সকলের নৈতিক দায়িত্ব। আমাদের সকলেই ঐক্যবদ্ধ হয়ে মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য কাজ করব ইনশাআল্লাহ্।
২১ শে ফেব্রুয়ারি ইতিহাস

১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তানে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন শুরু হয়। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় মেধাবী ছাত্রদের উপর বর্বরোচিত হামলা চালালে পুলিশের গুলিতে নিহত হন শত শত তরুণ। তাদের মহান আত্মত্যাগ যেন বাংলা ভাষাকে আলাদা এক মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছে। আর তাই, ভাষা আন্দোলনের ফলে বাংলা ভাষার মর্যাদা সম্পূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়। এছাড়াও, এই আন্দোলন বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার জাগরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তো প্রিয় পাঠক বুঝতে পারছেন নিশ্চয় ২১ শে ফেব্রুয়ারি পালনের উদ্দেশ্য কি?
২১ শে ফেব্রুয়ারি তাৎপর্য

২১ শে ফেব্রুয়ারি কি এবং এর ইতিহাস সম্পর্কে বুঝতে পারছেন নিশ্চয়। চলুন এবার আমরা ২১ শে ফেব্রুয়ারির তাৎপর্য সম্পর্কে জানার চেষ্টা করি।
মাতৃভাষার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা
২১ শে ফেব্রুয়ারি আমাদেরকে মাতৃভাষার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করে। আমাদেরকে শিক্ষা দেয় যে, মাতৃভাষা আমাদের জাতীয় পরিচয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষা করা আমাদের সকলের নৈতিক দায়িত্ব।
জাতীয়তাবাদী চেতনার জাগরণ

২১ শে ফেব্রুয়ারি বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার জাগরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি বাঙালিদেরকে ঐক্যবদ্ধ করে এবং স্বাধীনতার সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করে।
সাংস্কৃতিক উন্নয়নে অবদান

২১ শে ফেব্রুয়ারি বাঙালি সংস্কৃতির উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। এটি বাঙালিদের মধ্যে ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহ জাগায়। তাই, ২১ শে ফেব্রুয়ারি একটি ঐতিহাসিক ও তাৎপর্যপূর্ণ দিন। এটি আমাদেরকে মাতৃভাষার গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্য সম্পর্কে সচেতন করে আর সেই সাথে জাতীয়তাবাদী চেতনা জাগ্রত করতে বিশেষ অবদান রাখে। আশা করছি বিষয়টি বুঝতে পারছেন।
২১ শে ফেব্রুয়ারি ও ভাষা আন্দোলন

১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) ও পশ্চিম পাকিস্তান (বর্তমান পাকিস্তান) নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠিত হয়। কিন্তু দুই রাষ্ট্রের মধ্যে ভাষা, সংস্কৃতি ও অন্যান্য বিষয়ে পার্থক্য ছিল। পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ মানুষের ভাষা ছিল বাংলা, কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার চেষ্টা করে। আর এরই প্রেক্ষিতে ১৯৪৭ সালের পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তানে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার শুরু হয়ে যায় এক কঠিন যুদ্ধ। এই আন্দোলন ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে এসে চূড়ান্ত রূপ নেয়। শত শত শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয় বাংলা ভাষা। এই দিনকে শহীদ দিবস হিসেবে বিশেষভাবে পালন করা হয়। সুতরাং বুঝতে পারছেন নিশ্চয় একুশ মানে আমার ভাষা, মায়ের ভাষা, বাংলা ভাষার অহংকার।
সারাদেশে ২১ শে ফেব্রুয়ারী উদযাপন
একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের জাতীয় ছুটি। সারাদেশে বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে এই দিনটি উদযাপন করা হয়।
ঢাকায় একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপন

ঢাকায় একুশে ফেব্রুয়ারির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানটি অনুষ্ঠিত হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। এই অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, অন্যান্য সরকারী কর্মকর্তা, বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ এবং সাধারণ জনগণ অংশগ্রহণ করেন। শহীদদের স্মরণে তারা পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন এবং তাদের আত্মার শান্তি কামনা করেন। ঢাকার অন্যান্য অনুষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে-
- বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সামাজিক সংগঠন এবং ব্যক্তিরা এই দিনে উৎসবের অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। এই অনুষ্ঠানে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির উপর আলোচনা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং অন্যান্য কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হয়।
- বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সামাজিক সংগঠন শহরের বিভিন্ন এলাকায় মিছিল ও সমাবেশের আয়োজন করে। এই মিছিল ও সমাবেশে বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার দাবি জানানো হয়।
বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলে একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপন

বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলেও একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপন করা হয়। এই দিনটিতে বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় শহীদদের স্মরণে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এই সমাবেশে শহীদদের আত্মার শান্তি কামনা করা হয় এবং বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার দাবি জানানো হয়। বুঝতে পারছেন তো ২১ শে ফেব্রুয়ারির মহাত্ম।
বহুল জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন-উত্তর সমূহ
বাংলাদেশের ইতিহাসে ২১ শে ফেব্রুয়ারির মহান তাৎপর্য বর্ণনা করে শেষ করা সম্ভব নয়। ২১ শে ফেব্রুয়ারি নিয়ে কিছু কথা হৃদয়ে সত্যিই নাড়া দেয়। শত শত প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত রাষ্ট্রভাষা বাংলার গুরুত্ব কখনোই কমে যাবার নয়। এ জয় শুধু তাদের নয় যারা ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছেন বরং এ জয় আমাদের সকলের!
২১ শে ফেব্রুয়ারি নিয়ে কিছু কথা এ সম্পর্কে জানার পরও নিশ্চয় আরও কিছু প্রশ্ন হয়তো আপনার মনে উঁকি দিচ্ছে। আসুন জেনে নেওয়া যাক সেই সকল প্রশ্ন এবং উত্তরসমূহ-
২১ শে ফেব্রুয়ারি ‘শহীদ দিবস’ হিসেবে পালিত হয় কোন সময় থেকে?
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় থাকা অসংখ্য ছাত্র এবং জনতাকে লক্ষ্য করে পুলিশ যখন গুলি চালায় তখন শত শত প্রাণ ঝরে যায়। তাদের এই মহান আত্মত্যাগ আমাদের বাংলা ভাষাকে সন্মানে অধিষ্ঠিত করে। এই ঘটনার পর থেকে ২১ শে ফেব্রুয়ারিকে ‘শহীদ দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়।
২১ শে ফেব্রুয়ারি কেন পালন করা হয়?
ভাষা শহীদদের স্বরণ এবং তাদের প্রতি গভির শ্রদ্ধাবোধের কারণে আর সেই সাথে মাতৃভাষার প্রতি সচেতনতা বৃদ্ধির জন্যই মূলত ২১ শে ফেব্রুয়ারী পালন করা হয়। শুধু বাংলাদেশেয় নয় বরং পাশাপাশি বিশ্বের অনেক দেশেই একে বিশেষভাবে পালন করা হয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, ইউনেস্কো ১৯৯৯ সালে এই দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
উপসংহার
পৃথিবীর ইতিহাসে মাতৃভাষার জন্য জীবন দেওয়ার এমন ঘটনার নজির খুব কমই দেখা যায়। বিরের দেশ বাংলাদেশ যেখানে থাকা হাজারো দেশ প্রেমিক দেখিয়ে দিয়েছেন এদেশের প্রতি, এদেশের ভাষার প্রতি তাদের গভীর শ্রদ্ধাবোধ আর প্রেমময় ভালোবাসা।এছাড়াও আপনার জ্ঞানকে প্রসারিত করতে সততা সম্পর্কে ১০টি বাক্য এ সম্পর্কে পড়তে পারেন।
তো প্রিয় পাঠক, ‘২১ শে ফেব্রুয়ারি নিয়ে কিছু কথা‘ সম্পর্কিত আমাদের এই পোস্ট এবং ২১শে ফেব্রুয়ারির মূল তাৎপর্য সম্পর্কে সম্যক ধারণা পেয়েছেন নিশ্চয়। এ বিষয়ে আপনি কি নতুন কিছু জানেন? তাহলে অবশ্যই কমেন্ট করে আমাদেরকে জানিয়ে দিবেন কেমন! আপনাদের সুস্বাস্থ্য কামণা করে আজকের মত বিদায় নিচ্ছি। আল্লাহ হাফেজ।