কুমিল্লা কিসের জন্য বিখ্যাত – প্রিয় পাঠক এই প্রসঙ্গে একটি বিস্তর আলোচনা হয়ে যাক। কি বলেন আপনারা? কুমিল্লা জেলার ঐতিহ্য নিয়ে অনেকেই অনেক রকম প্রশ্ন করে থাকেন। তাদের প্রশ্নগুলোকে একত্রিত করে আমরা আজকের এই পোস্টটি সাজিয়েছি। চলুন দেরি না করে বরং আসল কথায় যাওয়া যাক-
কুমিল্লা কিসের জন্য বিখ্যাত
কুমিল্লা পূর্বে যাকে কমলাঙ্ক বলা হতো তার খুঁটিনাটি জানবো আজকে। কুমিল্লা কিসের জন্য বিখ্যাত তা বোঝার জন্য আপনাকে অবশ্যই কুমিল্লার ঐতিহ্য, খাবার, বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গ এবং দর্শনীয় স্থান সম্পর্কে সম্যক জানতে হবে। তাহলে দেরি কিসের? তবে মূল আলোচনায় যাওয়ার পূর্বে কুমিল্লা জেলাকে একটু ঘেটে দেখি-
কুমিল্লা সম্পর্কে কিছু তথ্য
কুমিল্লা বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত একটি শহর। কুমিল্লা নদীর তীরে অবস্থিত এই শহরটি বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন শহরগুলির মধ্যে একটি। কুমিল্লার ইতিহাস বেশ প্রাচীন। প্রাচীনকালে এই অঞ্চলটিতে বৌদ্ধ, হিন্দু ও মুসলিম সভ্যতা বিকাশ লাভ করেছিল। কুমিল্লা নদীর তীরে অবস্থিত শালবন বিহার ও আনন্দ বিহার এই অঞ্চলের প্রাচীনতম বৌদ্ধ বিহার। হিন্দু সভ্যতারও কিছু নিদর্শন এই অঞ্চলে পাওয়া গেছে। মুসলিম শাসনকালে কুমিল্লা একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর হিসেবে গড়ে ওঠে। কুমিল্লা শহর ২৩°০১’ থেকে ২৩°৪৭’ উত্তর অক্ষাংশে এবং ৯০°৩৯’ থেকে ৯১°২২’ পূর্ব দ্রাঘিমাংশে অবস্থিত। এটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৭২ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত। কুমিল্লা শহরের আয়তন ৫৩.০৪ বর্গ কিলোমিটার। ২০১১ সালের আদমশুমারী অনুসারে, কুমিল্লা শহরের জনসংখ্যা ছিল ৩,৩৯,১৩৩ জন। এর মধ্যে পুরুষ ১,৭৭,৩০০ জন এবং মহিলা ১,৬১,৮৩৩ জন। কুমিল্লা একটি সমৃদ্ধ সংস্কৃতির শহর। এই শহরে অনেকগুলি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। কুমিল্লায় প্রতি বছর অনেকগুলি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও উৎসব পালিত হয়।
কুমিল্লার বিখ্যাত খাবার সমূহ
কুমিল্লার বিশেষ বিশেষ খাবারগুলো তাদের স্বাদ আর বৈচিত্র্যের জন্য বিখ্যাত। এই জেলার বিখ্যাত খাবারগুলোর মধ্যে রয়েছে-
রসমালাই
কুমিল্লার সবচেয়ে বিখ্যাত খাবার হল রসমালাই। এটি একটি মিষ্টি খাবার যা দুধ, ছানা, চিনি ও বিভিন্ন মসলা দিয়ে তৈরি করা হয়। রসমালাই কুমিল্লার মনোহরপুর এলাকায় প্রথম তৈরি করা হয়। তবে বর্তমানে, কুমিল্লায় অনেকগুলি রসমালাই এর দোকান রয়েছে।
কাঁচামিঠা
কাঁচামিঠাও কুমিল্লার একটি বিখ্যাত মিষ্টি খাবার। দুধ, ছানা, চিনি ও বিভিন্ন মসলা দিয়ে তৈরি করা অনন্য এই খাবারের স্বাদ অতুলনীয়। তবে, রসমালাইয়ের মতো কাঁচামিঠা সিদ্ধ করা হয় না। এটিকে হালকা আঁচে জ্বাল দিয়ে তৈরি করা হয়।
খদ্দর
কুমিল্লার মুখরোচক খাবারগুলোর মধ্যে খদ্দর অন্যতম একটি। এটি চালের গুঁড়া, চিনি, লবণ, তেল ও বিভিন্ন মসলা দিয়ে তৈরি করা হয়। এই খাবার সাধারণত সকালে নাস্তায় খাওয়া হয়।
হাসনের দলা
কুমিল্লার বিখ্যাত খাবারগুলোর মধ্যে হাসনের দলাও বিখ্যাত মুখরোচক খাবার হিসেবে সর্বজন সমাদৃত। এটি চালের গুঁড়া, চিনি, লবণ, তেল ও বিভিন্ন মসলা দিয়ে তৈরি করা হয়। তবে, খদ্দরের মতো হাসনের দলাকে বলদায় বেলে তৈরি করা হয়।
কচুর মুখির ডাল
ডাল খেয়েছেন নিশ্চয়? কুমিল্লা গেলে কচুর মুখির ডাল খেয়ে দেখবেন। খুবেই সুস্বাদু এই ডাল। এটি কুমিল্লার একটি বিখ্যাত খাবার। কচুর মুখি, আলু, পেঁয়াজ, মরিচ, লবণ ও বিভিন্ন মসলা দিয়ে তৈরি করা হয় এটি। কচুর মুখির ডাল সাধারণত ভাতের সাথে খাওয়া হয়।
কাঁচা মরিচের চাটনি
কুমিল্লার আরো একটি বিখ্যাত খাবার এর মধ্যে কাঁচা মরিচের চাটনিও উল্লেখযোগ্য। এটি কাঁচা মরিচ, পেঁয়াজ, আদা, রসুন, লবণ ও বিভিন্ন মসলা দিয়ে তৈরি করা হয়। কাঁচা মরিচের চাটনি সাধারণত ভাতের সাথে খাওয়া হয়।
কুমিল্লার বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গ
- আ হ ম মোস্তফা কামাল – তিনি বাংলাদেশী রাজনীতিবিদ ও আইসিসির প্রাক্তন সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
- কাজী জাফর আহমেদ – খন্দকার মোশতাক আহমেদের মত তিনিও ছিলেন বাংলাদেশের একজন সফল রাজনীতিবিদ
- খন্দকার মোশতাক আহমেদ – খন্দকার মোশতাক আহমেদ একজন বাংলাদেশের স্বনামধন্য রাষ্ট্রপতি ছিলেন।
- আঞ্জুম সুলতানা সীমা – প্রখ্যাত বাংলাদেশী রাজনীতিবিদ। অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং ভালো মানুষ হিসেবে তাঁর যথেষ্ট কদর রয়েছে।
- আ. ক. ম. বাহাউদ্দিন বাহার – তিনি হচ্ছেন বাংলাদেশী জননন্দিত রাজনীতিবিদ
- মোহাম্মদ আবুল হাশেম – তিনি একজন বাংলাদেশী জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ
- আতিকুল ইসলাম – ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন এর নির্বাচিত মেয়র।
কুমিল্লার দর্শনীয় স্থান
বাংলাদেশের একটি প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী জেলা কুমিল্লায় অনেক দর্শনীয় স্থান রয়েছে, যা দেশি-বিদেশি পর্যটকদের বিশেষভাবে আকৃষ্ট করে। কুমিল্লার দর্শনীয় স্থানগুলির মধ্যে রয়েছে-
ময়নামতি জাদুঘর
ময়নামতি জাদুঘর বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলার কোটবাড়ি উপজেলার শালবন বিহারের দক্ষিণ পাশে অবস্থিত। এটি কুমিল্লার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘর। ময়নামতি জাদুঘরটি ১৯৬৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই জাদুঘরে ময়নামতি থেকে আবিষ্কৃত অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন রয়েছে। এগুলো ৭ম থেকে ১২শ শতাব্দীর মধ্যে নির্মিত হয়েছিল।
ডাইনো পার্ক
ডাইনো পার্ক বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলার কোটবাড়ি উপজেলার লালমাই পাহাড়ে অবস্থিত একটি থিম পার্ক। এটি বাংলাদেশের প্রথম এবং একমাত্র ডাইনোসর পার্ক। এই পার্কে বিভিন্ন ধরনের ডাইনোসর মূর্তি রয়েছে। এগুলির মধ্যে রয়েছে টি-রেক্স, ট্রাইসেরাস, ব্র্যাকিয়াওসরাস, স্পাইনোসরাস, ইত্যাদি। ডাইনোসরগুলির আকার ও গঠন অত্যন্ত বাস্তবতার সাথে মিল রেখে তৈরি করা হয়েছে।
বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমী
বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমী (আরডিএ) বাংলাদেশের একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান যা পল্লী উন্নয়ন, গ্রামীণ অর্থনীতি এবং গ্রামীণ সমাজের উন্নয়ন সম্পর্কিত গবেষণা, প্রশিক্ষণ এবং পরামর্শ প্রদান করে থাকে। এই একাডেমীটি ১৯শে জুন, ১৯৭৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়।
আনন্দ বিহার
আনন্দ বিহার বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলার কোটবাড়ি উপজেলার ময়নামতিতে অবস্থিত একটি প্রাচীন বৌদ্ধ বিহার। এটি ময়নামতিতে আবিষ্কৃত প্রাচীন সৌধমালার মধ্যে বৃহত্তম। আনন্দ বিহারের নির্মাণকাল সপ্তম বা অষ্টম শতাব্দীর প্রথম দিকে। এটি দেব রাজবংশের তৃতীয় শাসক শ্রী আনন্দ দেব নির্মাণ করেন। এই বিহারের আয়তন প্রায় ৬০০ মিটার বর্গ। এর চারপাশে রয়েছে একটি সুবিশাল প্রাচীর। প্রাচীরের ভেতরে রয়েছে অনেকগুলি কক্ষ। বিহারের কেন্দ্রস্থলে রয়েছে একটি বড় মন্দির। মন্দিরটি ক্রুশাকার এবং এর চারপাশে রয়েছে চারটি বুদ্ধমূর্তি।
জাহাপুর জমিদার বাড়ি
জাহাপুর জমিদার বাড়ি বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিভাগের কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর উপজেলার জাহাপুর গ্রামে অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক জমিদার বাড়ি। এই বাড়িটি ১৮৬২ সালে গৌরী মোহন রায়ের হাত ধরে নির্মিত হয়। জাহাপুর জমিদার বাড়িটি একটি বিশাল এলাকা জুড়ে অবস্থিত। এই বাড়িতে মোট ১০টি প্রাসাদ বা ভবন রয়েছে। এর মধ্যে দুইটি ভবন প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে। আর কয়েকটি লতাপাতায় জরাজীর্ণ হয়ে রয়েছে। বাকীগুলো মোটামুটি এখনো ভালো আছে।
শালবন বৌদ্ধ বিহার
শালবন বৌদ্ধ বিহার বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলার কোটবাড়ি উপজেলার ময়নামতিতে অবস্থিত একটি প্রাচীন বৌদ্ধ বিহার। শালবন বিহারের নির্মাণকাল সপ্তম শতাব্দীর শেষ থেকে অষ্টম শতাব্দীর প্রথম ভাগে। এটি দেববংশের চতুর্থ রাজা শ্রীভবদেব নির্মাণ করেন। শালবন বিহারের আয়তন প্রায় ৫০০ মিটার বর্গ। এর চারপাশে রয়েছে একটি সুবিশাল প্রাচীর।
রূপবান মুড়া
রূপবান মুড়া বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলার কোটবাড়ি উপজেলার শালবন বিহারের দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত একটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান। রূপবান মুড়ার খননকার্য ১৯৯০ সালে শুরু হয়। খননকার্যের ফলে এখানে একটি বিহার ও একটি মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে। বিহারটি ৩৪.১৪ মিটার × ২৫ মিটার (১১২.০ ফু × ৮২.০ ফু) পরিমাপের এবং মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ ২৮.৯৬ মিটার × ২৮.৯৬ মিটার (৯৫.০ ফু × ৯৫.০ ফু) পরিমাপের। বিহারটির পূর্ব পাশের প্রকৌষ্ঠ থেকে বেলে পাথরের কারুকাজ করা বৃহদাকার ১টি বৌদ্ধ মূর্তি পাওয়া যায়। ধারণা করা হয় মূর্তিটি ৭ম থেকে ১২শ শতাব্দীর।
রানী ময়নামতির প্রাসাদ
রানী ময়নামতির প্রাসাদ বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলার বুড়িচং উপজেলার ময়নামতিতে অবস্থিত একটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান। এটি লালমাই-ময়নামতি পাহাড়ের উত্তর প্রান্তে সমতল থেকে ১৫.২৪ মিটার উচ্চতায় একটি বিচ্ছিন্ন পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত। রানী ময়নামতির প্রাসাদের নির্মাণকাল ৮ম থেকে ১২শ শতাব্দী। এটি দেববংশের রাজা শ্রীভবদেবের স্ত্রী ময়নামতির নামে নির্মিত হয় বলে ধারণা করা হয়। প্রাসাদটি একটি বৌদ্ধ মন্দির হিসাবে নির্মিত হয়েছিল। এটি একটি ক্রুশাকার মন্দির। মন্দিরের চারপাশে রয়েছে চারটি বুদ্ধমূর্তি।
বহুল জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন-উত্তর সমূহ
কুমিল্লা কিসের জন্য বিখ্যাত এ সম্পর্কে জানার পরও নিশ্চয় আরও কিছু প্রশ্ন হয়তো আপনার মনে উঁকি দিচ্ছে। আসুন জেনে নেওয়া যাক সেই সকল প্রশ্ন এবং উত্তরসমূহ-
কুমিল্লা কত সালে জেলা হয়?
কুমিল্লা ১৯৬০ সালে জেলা হয়। ১৭৬৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ত্রিপুরা দখল করে ১৭৯০ সালে কোম্পানী শাসনামলে ত্রিপুরা নামের জেলার সৃষ্টি। পরবর্তীতে ১৯৬০ সালে বর্তমান ভারতের অন্তর্ভুক্ত ত্রিপুরা রাজ্য থেকে কুমিল্লাকে জেলা হিসেবে মর্যাদা দেয়া হয়।
বুড়িচং এর পূর্ব নাম কি?
বাংলাদেশের প্রসিদ্ধ জেলা কুমিল্লা এর জনপ্রিয় উপজেলা বুড়িচং এর পূর্ব নাম ছিল উত্তর বিজয়পুর।
উপসংহার
খাদি কাপড় ও রসমালাই এর জন্য বিখ্যাত জেলা কুমিল্লার রয়েছে ঐতিহাসিক এবং প্রত্মতাত্ত্বি ঐতিহ্য। এই জেলার বহু দর্শনীয় স্থান হাজার হাজার দর্শককে বিনোদন দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। কুমিল্লা কিসের জন্য বিখ্যাত এই সম্পর্কে আমাদের দেওয়া তথ্যগুলো আপনাদের কতটা উপকারে আসছে তা কমেন্ট করে জানাতে ভুলবেন না কেমন! এছাড়াও আপনার জ্ঞানকে প্রসারিত করতে যশোর কিসের জন্য বিখ্যাত এ সম্পর্কে পড়তে পারেন।
‘কুমিল্লা কিসের জন্য বিখ্যাত ‘তথা কুমিল্লা বিখ্যাত হওয়ার কারণগুলো নিশ্চয় বুঝতে পারছেন। পোস্টটি আপনাদের বিন্দুমাত্র উপকারে আসলেই আমরা লেখাটিকে স্বার্থক বলে মনে করবো। প্রিয় পাঠক, আজ আর নয়, পরবর্তী পোস্টে দেখা হবে ইনশাআল্লাহ্। সে পর্যন্ত ভালো থাকুন, আল্লাহ্ হাফেজ।