চাঁদপুর কিসের জন্য বিখ্যাত অনেকের মুখে এমন প্রশ্ন শুনেছেন হয়তো। কিন্তু সঠিক তথ্যের অভাবে বিষয়টি স্পষ্ট বলতে পারেন নাই নিশ্চয়। যদি এমন সমস্যায় পড়ে থাকেন তবে আপনার জন্য আমরা এই পোস্টে চাঁদপুর বিখ্যাত হওয়ার মূল কারণগুলো স্টেপ বাই স্টেপ তুলে ধরেছি। পড়তে থাকুন, আশা করছি আপনার সংশয় দূর হয়ে যাবে।
চাঁদপুর কিসের জন্য বিখ্যাত
চাঁদপুর বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত জেলা। চাঁদপুর ইলিশের জন্য বিশেষ খ্যাতিপ্রাপ্ত জেলা। আর তাই একে “ইলিশের বাড়ি” বলা হয়। এছাড়াওপদ্মা, মেঘনা ও ডাকাতিয়া নদীর মিলনস্থল হচ্ছে চাঁদপুর। বহু ঐতিহাসিক স্থাপনা আর সাংস্কৃতিক বৈচিত্রে ভরপুর চাঁদপুর কিসের জন্য বিখ্যাত তা এই পোস্টে বিশদভাবে তুলে ধরা হয়েছে। চলুন তাহলে পড়া যাক-
চাঁদপুর জেলা সম্পর্কে কিছু তথ্য
চাঁদপুর বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের চট্টগ্রাম বিভাগের একটি প্রশাসনিক অঞ্চল। এটি বাংলাদেশের ৮টি “এ” শ্রেণিভুক্ত জেলার একটি। পদ্মা, মেঘনা ও ডাকাতিয়া নদীর মিলনস্থলে এ জেলা অবস্থিত। ইলিশ মাছের অন্যতম প্রজনন অঞ্চল হিসেবে চাঁদপুরকে “ইলিশের বাড়ি চাঁদপুর” নামে ডাকা হয়। চাঁদপুর জেলার অবস্থান ২৩°১১′ থেকে ২৩°৩২′ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৯০°০৪′ থেকে ৯০°৩২′ পূর্ব দ্রাঘিমাংশের মধ্যে। এর উত্তরে নোয়াখালী জেলা, দক্ষিণে লক্ষ্মীপুর জেলা, পূর্বে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা এবং পশ্চিমে মেঘনা নদী ও নোয়াখালী জেলা অবস্থিত। চাঁদপুর জেলার আয়তন ১,৭০৪ বর্গ কিলোমিটার। ২০২২ সালের জনশুমারি অনুযায়ী চাঁদপুর জেলার মোট জনসংখ্যা ২৬,৩৫,৭৪৮ জন। এর মধ্যে পুরুষ ১২,২৮,৭৭৪ জন এবং মহিলা ১৪,০৫,৬৮২ জন
চাঁদপুরের বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গ
চাঁদপুরে থাকা অসংখ্য বিখ্যাত ব্যক্তি এই জেলাকে অন্যান্য জেলার তুলনায় আলাদা এক চমক দেওয়ার প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। আমাদের বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী জনাব ডাঃ দীপু মনি মেডামের বাসাও কিন্তু চাঁদপুরে!
- বর্তমান মাননিয় শিক্ষামন্ত্রী ডাঃ দীপু মনি – তিনি সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রীও ছিলেন।
- মাননীয় সংসদ সদস্য জনাব ড. মহিউদ্দীন খান আলমগীর – তিনি সাবেক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী ছিলেন।
- মাননীয় সংসদ সদস্য (১ নং সেক্টর কমান্ডার) – মেজর (অব.) রফিকুল ইসলাম – বীর উত্তম।
- ড. অধ্যাপক সামছুল আলম স্যার – মাননীয় পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী।
- লে. কর্নেল (অব.) আবু ওসমান চৌধুরী – বীর মুক্তিযোদ্ধা (৮ নং সেক্টর কমান্ডার)।
- পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর এর সাবেক মহাপরিচালক – ডাঃ কাজী মোস্তফা সারোয়ার।
- জনাব মুনতাসীর উদ্দিন খান মামুন – একজন লেখক ও শিক্ষাবিদ ছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এর দায়িত্ব পালন করেছেন।
- জনাব ইয়াকুব আলী পাটওয়ারী – পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের সদস্য প্রশাসন (সচিব )।
- শাইখ সিরাজ – চ্যানেল আইয়ের পরিচালক ও বার্তা প্রধান এবং জনপ্রিয় গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব।
- এসডি রুবেল – নন্দিত সংগীত শিল্পী।
- জনাব গোলাম হোসেন – জাতীয় রাজস্ব বিভাগ NBR এর সাবেক চেয়ারম্যান।
চাঁদপুরের বিখ্যাত খাবার
চাঁদপুর জেলা তার সুস্বাদু খাবার এবং ঐতিহ্যবাহী রান্নার জন্য বিখ্যাত। চাঁদপুরের বিখ্যাত খাবারের মধ্যে রয়েছে-
ইলিশ মাছ
চাঁদপুরের বিখ্যাত খাবারের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হলো ইলিশ মাছ। চাঁদপুর জেলাটি ইলিশের অন্যতম প্রজনন অঞ্চল। চাঁদপুরে বিভিন্নভাবে ইলিশ মাছ রান্না করা হয়, যেমন ভাজা, ঝোল, মালাইকারি, কাবাব, চচ্চড়ি ইত্যাদি।
রসগোল্লা
চাঁদপুরের আরেকটি বিখ্যাত খাবার হলো রসগোল্লা। চাঁদপুরের রসগোল্লার স্বাদ অতুলনীয়।
চিতই পিঠা
চাঁদপুরের চিতই পিঠাও বেশ বিখ্যাত। চিতই পিঠার সাথে চাঁদপুরের বিভিন্ন রকমের ঝোল, যেমন ইলিশ মাছের ঝোল, মাংসের ঝোল, ডালের ঝোল ইত্যাদি পরিবেশন করা হয়।
চমচম
চাঁদপুরের চমচমও বেশ জনপ্রিয়। চাঁদপুরের চমচম তৈরি হয় দুধ থেকে।
পায়েস
চাঁদপুরের পায়েসও চমচমের মতই বেশ সুস্বাদু। এই পায়েস তৈরি হয় নারিকেলের দুধ, চিনি এবং এলাচ দিয়ে।
এছাড়াও, চাঁদপুরের আরও কিছু বিখ্যাত খাবারের মধ্যে রয়েছে: মালাইকারি, কাঁচা মরিচের ভর্তা উল্লেখযোগ্য।
চাঁদপুরের দর্শনীয় স্থান
চাঁদপুর জেলা তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং ঐতিহাসিক ঐতিহ্যের জন্য বিখ্যাত। চাঁদপুরের উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থানগুলির মধ্যে রয়েছে-
হযরত শাহরাস্তির মাজার
হযরত শাহরাস্তির মাজার বাংলাদেশের চাঁদপুর জেলার হাজীগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত। হযরত শাহরাস্তি ছিলেন একজন সুফি সাধক এবং দরবেশ। তিনি ১৫ শতকে ভারতের তুঘলক রাজবংশের আমলে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ইসলাম ধর্ম প্রচারের জন্য ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণ করেন। পরে তিনি চাঁদপুর জেলায় আসেন এবং এখানেই তার মৃত্যু হয়। হযরত শাহরাস্তির মাজারটি একটি ঐতিহাসিক এবং ধর্মীয় স্থান। এটি চাঁদপুর জেলার অন্যতম জনপ্রিয় দর্শনার্থীদের আকর্ষণ। মাজারটিতে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ নামাজ পড়তে এবং হযরত শাহরাস্তির মাজার জিয়ারত করতে আসেন। মাজারটি একটি সুন্দর স্থাপত্য নিদর্শন। এটি একটি উঁচু বেদির উপর অবস্থিত। বেদিটি চারপাশে বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা। মাজারটিতে একটি সুন্দর গম্বুজ এবং একটি ছোট মিনার রয়েছে। মাজারের ভেতরে হযরত শাহরাস্তির সমাধি রয়েছে। সমাধিটি একটি সুন্দর কারুকার্য করা মার্বেল পাথরের তৈরি। সমাধির চারপাশে বিভিন্ন ধরনের বাতি ও মোমবাতি জ্বালানো হয়।
রূপসা জমিদার বাড়ি
রূপসা জমিদার বাড়ি বাংলাদেশের চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ উপজেলার রূপসা গ্রামে অবস্থিত। এটি ১৮ শতকের মাঝামাঝি সময়ে নির্মিত হয়েছিল। জমিদার বাড়িটির প্রতিষ্ঠাতা হলেন আহম্মদ রাজা। তিনি ব্রিটিশদের কাছ থেকে জমিদারি কিনে নিয়ে এই বাড়িটি নির্মাণ করেছিলেন। রূপসা জমিদার বাড়িটি ইট দিয়ে তৈরি। জমিদার বাড়িটির মূল ভবনটি তিনতলা বিশিষ্ট। মূল ভবনের সামনে একটি বড় পুকুর আছে। পুকুরের চারপাশে ঘাট আছে। জমিদার বাড়ির ভিতরে রয়েছে একটি মসজিদ, একটি কবরস্থান এবং কিছু আবাসিক ভবন। রূপসা জমিদার বাড়িটি বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক নিদর্শন। এটি বাংলাদেশের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর দ্বারা সংরক্ষিত।
হাজীগঞ্জ ঐতিহাসিক বড় মসজিদ
হাজীগঞ্জ ঐতিহাসিক বড় মসজিদ বাংলাদেশের চাঁদপুর জেলার হাজীগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক মসজিদ। এটি ১৩৩৭ বঙ্গাব্দে হাজী আহমদ আলী পাটোয়ারী প্রতিষ্ঠা করেন। মসজিদটি আয়তনের দিক দিয়ে উপমহাদেশের অন্যতম সর্ববৃহৎ মসজিদ। এর আয়তন প্রায় ২৮,৪০০ বর্গফুট। মসজিদটিতে একসাথে প্রায় ১০,০০০ মুসল্লী নামাজ আদায় করতে পারেন। মসজিদটি বর্গাকার আকৃতির। এর চারপাশে চারটি মিনার রয়েছে। প্রতিটি মিনারের উচ্চতা ১৮৮ ফুট। মসজিদের ভেতরের ছাদটি লোহার কাঠামো দিয়ে তৈরি এবং উপরে টাইলস লাগানো। মসজিদের দেয়ালে বিভিন্ন নকশা করা আছে।
লোহাগড়া মঠ
লোহাগড়া মঠ বাংলাদেশের চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ উপজেলার লোহাগড় গ্রামে অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক মঠ। এটি প্রায় চার থেকে সাত শতাব্দী পুরাতন প্রাচীন এই মঠ চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ উপজেলার লোহাগড় গ্রামে ডাকাতিয়া নদীর পাশে অবস্থিত। যা লোহাগড় জমিদার বাড়ির জমিদাররা তৈরি করেছিলেন। লোহাগড়া মঠটি তিনটি অংশে বিভক্ত: একটি বড় মঠ, একটি ছোট মঠ এবং একটি মাটির নিচের গহবর। বড় মঠটি সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয়। এটি আয়তাকার আকৃতির এবং এর উচ্চতা প্রায় ১০০ ফুট। মঠের দেয়ালে বিভিন্ন নকশা করা আছে। ছোট মঠটি বড় মঠের পাশে অবস্থিত। এটিও আয়তাকার আকৃতির এবং এর উচ্চতা প্রায় ৫০ ফুট। মাটির নিচের গহবরটি মঠের পিছনে অবস্থিত। এটি প্রায় ১০০ ফুট গভীর। গহবরটিতে বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া গেছে। বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক নিদর্শন এই লোহাগড়া মঠ বাংলাদেশের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর দ্বারা সংরক্ষিত।
বহুল জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন-উত্তর সমূহ
বাংলাদেশের অত্যন্ত জনপ্রিয় জেলা চাঁদপুর এ রয়েছে শত শত দেখার মত জায়গা। এগুলো দর্শনের জন্য প্রতিদিন তাই হাজার হাজার মানুষ ভিড় জমায়। চাঁদপুর কিসের জন্য বিখ্যাত তার বিস্তারিত তথ্য পড়ার পর নিশ্চয় আপনার মনে কিছু প্রশ্ন তৈরী হয়েছে। চলুন তো দেখি – ঠিক নিচের প্রশ্নগুলোই কি আপনার মনেও ভাসছে!
প্রশ্নঃ চাঁদপুর জেলার নামকরণ কিভাবে হয়েছিল?
উত্তরঃ চাঁদপুর জেলার নামকরণ নিয়ে দুটি মতবাদ রয়েছে। প্রথম মতবাদ অনুসারে, চাঁদপুর জেলার নামকরণ হয়েছিল চাঁদ নামে এক সুফি সাধকের নামানুসারে। চাঁদ ছিলেন একজন ধর্মপ্রচারক এবং তিনি ধলেশ্বরী নদীর তীরে একটি খানকা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই খানকার চারপাশে জনবসতি গড়ে উঠে এবং সেই জনবসতিকে চাঁদপুর বলা হয়। দ্বিতীয় মতবাদ অনুসারে, চাঁদপুর জেলার নামকরণ হয়েছিল চাঁদের নগরী বলে। এই মতবাদ অনুসারে, চাঁদপুর জেলাটি পদ্মা, মেঘনা ও ডাকাতিয়া নদীর মিলনস্থলে অবস্থিত। এই তিনটি নদীর মিলিত স্রোত চাঁদের মতোই জ্বলজ্বল করে। তাই এই জেলাটিকে চাঁদের নগরী বলা হয়।
প্রশ্নঃ চাঁদপুর জেলার প্রধান মৎস্য হলো কী?
উত্তরঃ চাঁদপুর জেলার প্রধান মৎস্য হলো ইলিশ। চাঁদপুর জেলাটি ইলিশের অন্যতম প্রজনন অঞ্চল।
প্রশ্নঃ চাঁদপুর জেলার শিক্ষা ব্যবস্থা কেমন?
উত্তরঃ চাঁদপুর জেলার শিক্ষা ব্যবস্থা বেশ উন্নত। জেলায় অনেক সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, চাঁদপুর জেলার সাক্ষরতার হার ৫৬.৮%।
উপসংহার
চাঁদপুর কিসের জন্য বিখ্যাত এই প্রসঙ্গে চাঁদপুরে থাকা শৈল্পিক কারুকার্যময় অনন্য সব রাজবাড়ি, অতুলনীয় স্বাদের ইলিশ মাছের কথা, সুন্দর আর বৈচিত্রময় স্থান আমাদের মনে পরম প্রশান্তি বয়ে আনে। এছাড়াও আপনার জ্ঞানকে প্রসারিত করতে সিরাজগঞ্জ কিসের জন্য বিখ্যাত এ সম্পর্কে পড়তে পারেন।
‘চাঁদপুর কিসের জন্য বিখ্যাত‘ পোস্টটি কেমন লাগলো কমেন্ট করে জানাবেন কিন্তু! প্রিয় পাঠক, কখনো চাঁদপুর গেলে সেখানে থাকা প্রাচীন নিদর্শনগুলো দেখতে ভুলবেন না! বুঝতে পারবেন প্রকৃতির বিচিত্র আবিষ্কার আপনাকে চিন্তা নামক আলাদা এক জগতের সাথে আলিঙ্গন করিয়ে দিচ্ছে। কথা তো অনেক হয়ে গেলো। আজ আর না বললে হয় না! আল্লাহ হাফেজ।