ফরিদপুর কিসের জন্য বিখ্যাত তা আমাদের মধ্যে অনেকেই জানেন না, তাই আজকের আলোচনাটি মূলত তাদের উদ্দেশ্যে। ফরিদপুর বিখ্যাত হওয়ার অন্যতম কারণ তথা ফরিদপুরের বিখ্যাত ব্যক্তি, দর্শনীয় স্থানসহ আরো বিস্তারিত তথ্য থাকছে আজকের পোস্টে। তাহলে প্রিয় পাঠক আর দেরী নয়, চলুন আমরা বরং দেখে নিই ফরিদপুর আসলে বিখ্যাত কেন?
ফরিদপুর কিসের জন্য বিখ্যাত
বাংলাদেশের অন্যতম এবং ঐতিহ্যবাহী জেলা ফরিদপুর এ রয়েছে হাজারো স্বনামধন্য ব্যক্তি, রয়েছে শত শত দর্শনীয় জায়গা। এগুলোর বিষয়ে বিস্তারিত জানার পর আশা করছি আপনার ইচ্ছে জাগবে ফরিদপুর যাওয়ার। আসলে ফরিদপুর বেশ কয়েকটি কারণে বিখ্যাত। আলোচনার এ পর্যায়ে আমরা দেখবো, ফরিদপুর কিসের জন্য বিখ্যাত তার বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য কারণ।
পল্লীকবি জসীমউদ্দীন
ফরিদপুর জেলার তালেবপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন পল্লীকবি জসীমউদ্দীন। তিনি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম বিখ্যাত কবি। তার বিখ্যাত রচনাগুলির মধ্যে রয়েছে “নকশী কাঁথার মাঠ”, “সোজন বাদিয়ার ঘাট”, “রাঙিলা নায়ের মাঝি”, “হাসু”, “এক পয়সার বাঁশী” ইত্যাদি।
ফরিদপুরের মসজিদ
ফরিদপুরে অনেক প্রাচীন মসজিদ রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-
- গেরদা মসজিদ (১০১৩ হিজরি)
- পাথরাইল মসজিদ ও দিঘী (১৪৯৩-১৫১৯ খ্রি.)
- সাতৈর মসজিদ (১৫১৯ খ্রি.)
- ফারুকী মসজিদ (১৫৪০ খ্রি.)
ফরিদপুর জেলা বিখ্যাত হওয়ার জন্য এসব ঐতিহাসিক স্থাপনার বিশেষ গুরুত্ব লক্ষ্য করা যায়।
ফরিদপুরের ঐতিহাসিক স্থান
ফরিদপুরে বেশ কয়েকটি ঐতিহাসিক স্থান রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটির নাম আমরা আপনাদের সুবিধার্থে এখানে সংযুক্ত করছি।
- ফরিদপুর দুর্গ
- চৌধুরী বাজার
- মির্জাপুর
- পাথরাইল
- তেলিগাতি
ফরিদপুরের পদ্মার ইলিশ
ফরিদপুরের পদ্মা নদীতে প্রচুর ইলিশ মাছ পাওয়া যায়। ফরিদপুরের ইলিশ বিখ্যাত। পদ্মা নদীর এই অনন্য ইলিশ মনে এক আলাদা প্রতিক্রিয় সৃষ্টি করে।
ফরিদপুরের খেজুরের গুড়
আপনি নিশ্চয় খেজুর এর গুড় দেখেছেন। এতিহ্যবাহী জেলা ফরিদপুরে প্রচুর খেজুর গাছ জন্মে। আর তাই ফরিদপুরের খেজুরের গুড় বিশেষভাবে খ্যাত।
ফরিদপুরের পাট
ফরিদপুরের পাট বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান পাট উৎপাদনকারী অঞ্চল। তাহলে কি বুঝলেন বলুন তো! ফরিদপুর পাটের জন্য বিখ্যাত।
ফরিদপুরের সার্কিট হাউস
ফরিদপুরের সার্কিট হাউসটি ১৮৯৯ সালে নির্মিত হয়। এটি একটি সুন্দর স্থাপত্য নিদর্শন। মনে রাখবেন, ফরিদপুর একটি সমৃদ্ধ ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির জেলা। এই জেলা বাংলা সাহিত্য, ইতিহাস, সংস্কৃতি, এবং অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
ফরিদপুর জেলা পরিচিতি
ফরিদপুর জেলা বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চলের একটি প্রশাসনিক জেলা। এটি ঢাকা বিভাগের অন্তর্গত। জেলাটির আয়তন ২০৭২.৭২ বর্গ কিলোমিটার। জনসংখ্যা মোট ১,৪৬,৯২১ জন। ফরিদপুর জেলার উত্তরে রাজবাড়ী জেলা, পূর্বে গোপালগঞ্জ জেলা, দক্ষিণে মাদারীপুর জেলা এবং পশ্চিমে যশোর জেলা অবস্থিত। ফরিদপুর জেলার প্রধান নদীগুলো হল যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, পদ্মা, গড়াই, চিত্রা, মধুমতি, ধলেশ্বরী, ভৈরব, কুমারখালী, মাথাভাঙ্গা, গড়িয়া ও আড়িয়াল খাঁ।
ফরিদপুর জেলার প্রধান শহরগুলো হল ফরিদপুর, ভাঙ্গা, চরভদ্রাসন, সালথা, বোয়ালমারী, মধুখালী, নগরকান্দা, আলফাডাঙ্গা, সদরপুর, মধুখালী, নগরকান্দা, আলফাডাঙ্গা, সদরপুর। ফরিদপুর জেলার প্রধান কৃষি পণ্যের মধ্যে রয়েছে ধান, পাট, গম, আখ, সরিষা, মটর, ছোলা, ডাল, শাকসবজি, ফলমূল ইত্যাদি। আবার প্রধান শিল্পগুলো হল কৃষিভিত্তিক শিল্প, খাদ্য শিল্প, বস্ত্র শিল্প, ইস্পাত শিল্প, কাগজ শিল্প, রাসায়নিক শিল্প, চামড়া শিল্প, আসবাবপত্র শিল্প, ঔষধ শিল্প ইত্যাদি।
ফরিদপুর বিখ্যাত খাবার
ফরিদপুর জেলার খাবার তার ঐতিহ্য ও স্বাদের জন্য বিখ্যাত। অন্যান্য খাবার উপাদানের মতই ফরিদপুরের খাবারগুলোতে সুস্বাদু ও পুষ্টিকর উপাদান বেশি পরিমাণে ব্যবহার করা হয়। ফরিদপুরের বিখ্যাত খাবারগুলোর মধ্যে রয়েছে-
খোকা মিঞার রসগোল্লা
ফরিদপুরের সবচেয়ে বিখ্যাত খাবার হল খোকা মিঞার রসগোল্লা। খোকা মিঞার রসগোল্লা তার ঐতিহ্যবাহী স্বাদের জন্য বিখ্যাত। এটি তৈরি করা হয় গুঁড়া দুধ, চিনি, এলাচ ও অন্যান্য উপাদান দিয়ে।
বোয়ালমারীর মিষ্টি
বোয়ালমারী উপজেলায় অনেক মিষ্টির দোকান রয়েছে। এই দোকানগুলোতে তৈরি করা মিষ্টিগুলো তাদের নিজস্ব স্বাদের জন্য বিখ্যাত।
আলু চপ
ফরিদপুরের আরেকটি বিখ্যাত খাবার হল আলু চপ। এটি তৈরি করা হয় আলু, পেঁয়াজ, মরিচ, লবণ, মসলা ও অন্যান্য উপাদান দিয়ে। ফরিদপুরের আলু চপ তার নরম ও সুস্বাদু স্বাদের জন্য বিখ্যাত।
চিংড়ি মালাইকারি
ফরিদপুরের চিংড়ি মালাইকারি তার সুস্বাদু ও সুগন্ধি স্বাদের জন্য বিখ্যাত। এটি তৈরি করা হয় চিংড়ি, দুধ, মালাই, মসলা ও অন্যান্য উপাদান দিয়ে।
মাছের কাবাব
ফরিদপুরের মাছের কাবাব অত্যন্ত সুস্বাদু। এটি তৈরি করা হয় মাছ, পেঁয়াজ, মরিচ, লবণ, মসলা ও অন্যান্য উপাদান দিয়ে।
ফরিদপুর দর্শনীয় স্থান
ফরিদপুর জেলা বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ জেলা যার প্রাচীন ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি অনন্য। ফরিদপুর জেলায় অনেক দর্শনীয় স্থান রয়েছে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে-
আড়িয়াল খাঁ বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য
আড়িয়াল খাঁ বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য হল বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য। এটি ফরিদপুর জেলার সদর উপজেলায় অবস্থিত। আড়িয়াল খাঁ বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে অনেক প্রজাতির বন্যপ্রাণী রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে বাঘ, হাতি, হরিণ, বুনো শূকর, বানর, চিতাবাঘ, শিয়াল, সিংহ, চিত্রা হরিণ, বুনো মহিষ, কুমির, বন্য কচ্ছপ ইত্যাদি।
পোড়াদহ জমিদার বাড়ি
পোড়াদহ জমিদার বাড়ি হল ফরিদপুর জেলার একটি ঐতিহাসিক জমিদার বাড়ি। এটি পোড়াদহ উপজেলায় অবস্থিত। এই জমিদার বাড়িটি তার স্থাপত্যের জন্য বিখ্যাত।
রাঘবপুর জমিদার বাড়ি
রাঘবপুর জমিদার বাড়ি হল ফরিদপুর জেলার একটি ঐতিহাসিক জমিদার বাড়ি। এটি রাঘবপুর উপজেলায় অবস্থিত। রাঘবপুর জমিদার বাড়িটি তার স্থাপত্যের জন্য বিখ্যাত।
বালিয়াকান্দি জমিদার বাড়ি
বালিয়াকান্দি জমিদার বাড়ি হল ফরিদপুর জেলার একটি ঐতিহাসিক জমিদার বাড়ি। এটি বালিয়াকান্দি উপজেলায় অবস্থিত এবং এই জমিদার বাড়িটি তার স্থাপত্যের জন্য বিখ্যাত।
ফরিদপুরের বিখ্যাত ব্যক্তি
ফরিদপুর জেলা বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ জেলা। এটি তার প্রাচীন ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির জন্য বিখ্যাত। ফরিদপুর জেলায় অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি জন্মগ্রহণ করেছেন। আপনাদের সুবিধার্থে কয়েকজন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তির নাম এখানে দিচ্ছি-
হাজী শরীয়তুল্লাহ
হাজী শরীয়তুল্লাহ (১৭৮১-১৮৪০) ছিলেন একজন বিখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ ও সংস্কারক। তিনি ফরিদপুর জেলার মাদারীপুর মহকুমার শ্যামাইল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বঙ্গদেশে ফরায়েজী আন্দোলনের প্রবর্তক ছিলেন।
পল্লী কবি জসীম উদ্দীন
পল্লী কবি জসীম উদ্দীন (১৯০৩-১৯৭৬) ছিলেন একজন বিখ্যাত বাঙালি কবি, লেখক ও নাট্যকার। তিনি ফরিদপুর জেলার সালথা উপজেলার মধুখালী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি “নকশী কাঁথার মাঠ”, “ধানসিঁড়ি”, “বেদের মেয়ে জোছনা” প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থের জন্য বিখ্যাত।
অম্বিকাচরণ মজুমদার
অম্বিকাচরণ মজুমদার (১৮৫১-১৯২২) ছিলেন একজন বিখ্যাত বাঙালি, রাজনীতিবিদ ও আইনজীবী। তিনি ফরিদপুর জেলার সদর উপজেলার রামপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি ছিলেন।
নবাব আব্দুল লতিফ
নবাব আব্দুল লতিফ (১৮৩৭-১৮৯৬) ছিলেন একজন বিখ্যাত বাঙালি রাজনীতিবিদ ও সমাজসেবক। তিনি ফরিদপুর জেলার সদর উপজেলার ফরিদপুর শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ফরিদপুর কলেজের প্রতিষ্ঠাতাও বটে।
মীর মশাররফ হোসেন
মীর মশাররফ হোসেন (১৮৮৭-১৯৬৪) ছিলেন একজন বিখ্যাত বাঙালি ঔপন্যাসিক, নাট্যকার ও সাংবাদিক। তিনি ফরিদপুর জেলার সদর উপজেলার কালুখালী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি “বিষাদ সিন্ধু”, “আনন্দময়ী”, “দুঃখীর বন্ধু”, “আলমগীর”, “শেরেবাংলা” প্রভৃতি উপন্যাস রচনা করেন।
মুন্সী আবদুর রউফ
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আবদুর রউফ (১৯৪৩-১৯৭১) ছিলেন একজন বিখ্যাত বাঙালি মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ফরিদপুর জেলার মধুখালী উপজেলার ছালামতপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর মিরপুরের বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আবদুর রউফ স্মৃতিসৌধের কাছে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে শহীদ হন। ফরিদপুর জেলায় অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি রয়েছেন যারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রেখে ফরিদপুর জেলাকে গৌরবময় করে তুলেছেন।
বহুল জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন-উত্তর সমূহ
অসংখ্য দর্শনীয় স্থান আর বিখ্যাত ব্যক্তিসহ নানাবিধ বৈশিষ্ট্য ভরপুর ফরিদপুর কিসের জন্য বিখ্যাত নিশ্চয় বুঝতে পারছেন। চলনু এ সম্পর্কিত জরুরী কিছু প্রশ্নোত্তর জেনে নেওয়া যাক-
ফরিদপুর পাটের জন্য বিখ্যাত কেন?
ফরিদপুর জেলা পাটের জন্য বিখ্যাত কারণ ফরিদপুরের মাটি পাট চাষের জন্য খুবই উপযোগী। ফরিদপুর জেলার মাটি দোআঁশ ও পলি দোআঁশ। এই মাটিতে পাট ভালোভাবে জন্মায় এবং ভালো ফলন দেয়। এছাড়াও, ফরিদপুর জেলায় প্রচুর পরিমাণে জল সম্পদ রয়েছে। এই জল সম্পদ পাট চাষের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
ফরিদপুর জেলায় পাট চাষের ইতিহাস অনেক পুরনো। ব্রিটিশ আমল থেকেই ফরিদপুর জেলায় পাট চাষ করা হয়ে আসছে। ফরিদপুর জেলার পাট সারা বিশ্বে বিখ্যাত। ফরিদপুরের পাট থেকে তৈরি কাপড়, চট, দড়ি, মোড়ক ইত্যাদি বিভিন্ন পণ্য দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি করা হয়।
ফরিদপুর জেলার থানা কয়টি?
এদেশের ঐতিহ্যবাহী জেলা ফরিদপুর যেখানে মোট ৯টি থানা রয়েছে। থানাগুলির নাম এক নজরে দেখে নিন।
- কোতয়ালী থানা
- মধুখালী থানা
- বোয়ালমারী থানা
- আলফাডাঙ্গা থানা
- নগরকান্দা থানা
- ভাংগা থানা
- সদরপুর থানা
- চরভদ্রাসন থানা
উপসংহার
সৌন্দর্যময় এই বাংলাদেশের ৬৪ জেলার মধ্যে অনন্য হচ্ছে ফরিদপুর জেলা যা বহু ঐতিহ্যে ভরপুর। আপনি যদি কখনো ফরিদপুর যান তবে সেখানে থাকা দর্শনীয় স্থানগুলো দেখার চেষ্টা করবেন। তাহলে বুঝতে পারবেন ফরিদপুর কিসের জন্য বিখ্যাত। এছাড়াও আপনার জ্ঞানকে প্রসারিত করতে ময়মনসিংহ কিসের জন্য বিখ্যাত এ সম্পর্কে পড়তে পারেন।
দীর্ঘ সময় নিয়ে ‘ফরিদপুর কিসের জন্য বিখ্যাত পোস্টটি‘ পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। ভালো লাগলে বন্ধুদের সাথে শেয়ার করতে ভুলবেন না কেমন!