বাচ্চাদের হঠাৎ জ্বর হলে করণীয় পদক্ষেপগুলো সম্পর্কে অধিকাংশ বাবা-মা জানে না। শিশুর জ্বর – শব্দটি শুনলেই মা-বাবার মনে জাগে এক অজানা আতঙ্ক। কপালে হাত, চোখে অশ্রু, মনে অগাধ দুঃখ – এই চিত্র সবার কাছেই পরিচিত। হ্যাঁ, শিশুর জ্বর আসলেই এক ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার সৃষ্টি হয়। তবে মনে রাখবেন, ভয় পেলেই সমস্যার সমাধান হয় না। বরং বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ করে আপনি আপনার শিশুর জ্বর কমাতে পারবেন এবং তাকে সুস্থ করে তুলতে পারবেন।
তাই এই আর্টিকেলে আমরা বাচ্চাদের হঠাৎ জ্বর হলে করণীয় বিষয় গুলো সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো। জ্বর কেন হয়, কখন ডাক্তারের কাছে যেতে হবে এবং ঘরে বসে কিভাবে জ্বর কমানো যায় – এই সকল প্রশ্নের উত্তর খুজে বের করবো। এছাড়াও, শিশুর জ্বরের সময় কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মনে রাখার কথাও তুলে ধরবো।
কেন বাচ্চাদের হঠাৎ জ্বর আসে?
বাচ্চাদের হঠাৎ জ্বর হলে করণীয় কি – তা জানার আগে আমাদের বাচ্চাদের হঠাৎ জ্বর আসার কারণ গুলো সম্পর্কে জেনে নিতে হবে। কেননা, বর্তমান সময়ে বিভিন্ন কারণে আমাদের প্রিয় শিশুরা জ্বরে আক্রান্ত হতে পারে। তবে তার মধ্যে সাধারন কিছু কারণ নিচে উল্লেখ করা হলো। যেমন,
১। ভাইরাস
শিশুর জ্বরের অনেক কারণ থাকতে পারে। এর মধ্যে সবচেয়ে সাধারণ হল ভাইরাস। এই ভাইরাস জনিত সংক্রমণের ফলে শিশুর সর্দি, কাশি, ফ্লু, ডায়রিয়া, ইত্যাদি হতে পারে এবং এইসব রোগের সাথে জ্বরও দেখা দেয়।
২। ব্যাকটেরিয়া
ছোটো শিশুদের শরীরে ব্যাকটেরিয়া প্রবেশের মাধ্যমে সংক্রমণ হয়ে থাকে। যে সংক্রমণ ফুসফুস (নিউমোনিয়া), কান (ওটিটিস মিডিয়া), প্রস্রাবের নালী (UTI) ইত্যাদিতে হতে পারে। আর এই সংক্রমণের ফলে বাচ্চাদের শরীরে জ্বর শুরু হয়।
৩। প্যারাসাইট
মশার কামড়ানোর মাধ্যমে ম্যালেরিয়া রোগ ছড়ায়। জ্বর, ঠান্ডা লাগা, মাথাব্যথা, পেশী ব্যথা, বমি বমি ভাব – এগুলো ম্যালেরিয়ার সাধারণ লক্ষণ। শিশুদের ক্ষেত্রে, জ্বরের সাথে দেখা দিতে পারে ডায়রিয়া, কনভালশন (চেতনা হারানো) এমনকি মৃ*ত্যুও হতে পারে।
এছাড়াও দূষিত খাবার এবং পানির মাধ্যমে টাইফয়েড জীবাণু শরীরে প্রবেশ করে। জ্বর, মাথাব্যথা, পেট ব্যথা, ডায়রিয়া, ক্ষুধামন্দা, দুর্বলতা – এগুলো টাইফয়েডের লক্ষণ। শিশুদের ক্ষেত্রে, জ্বর বেশি থাকে, আবার কখনও কখনও ডায়রিয়ার সাথে রক্তও দেখা দিতে পারে।
৪। টিকা
টিকা দেওয়ার পর শিশুর জ্বর আসার পেছনে মূল কারণ হলো টিকা দেওয়ার ফলে শরীরে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা সক্রিয় হয়ে ওঠে। টিকা দেওয়ার পর, শরীর ভ্যাকসিনে থাকা উপাদান দুর্বল বা নিষ্ক্রিয় জীবাণু বা ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে। এই লড়াইয়ের ফলে কিছু রাসায়নিক নিঃসৃত হয় যা জ্বর সৃষ্টি করে।
বাচ্চাদের হঠাৎ জ্বরের লক্ষণ ও উপসর্গ
শিশুরা আমাদের জীবনের আলো। তাদের হাসি, খেলাধুলা, কথা-বার্তা সবকিছুই আমাদের মন ভরে দেয়। কিন্তু যখন তারা অসুস্থ হয়ে পড়ে, তখন আমাদের মনটা কেমন যেন অস্থির হয়ে যায়। বিশেষ করে জ্বর হলে শিশুরা বেশি কষ্ট পায়। তাই আমাদের সবার উচিত বাচ্চাদের জ্বরের লক্ষণ ও উপসর্গ গুলো জেনে নেওয়া। আর আপনার সুবিধার জন্য নিচে বাচ্চাদের হঠাৎ জ্বরের লক্ষণ ও উপসর্গ গুলো তুলে ধরা হলো।
- কপাল, পিঠ বা বুকে স্পর্শ করলে গরম অনুভূত হবে।
- বাচ্চাদের শরীরে ১০০.৪°F (৩৮°C) এর বেশি তাপমাত্রা দেখা যাবে।
- শিশুরা ঠান্ডা অনুভব করবে এবং কাঁপতে পারে।
- শরীরে ব্যথা বা অস্বস্তি দেখা দিতে পারে।
- জ্বরের সাথে মাথাব্যথা হতে পারে।
- শিশু স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ক্লান্ত বোধ করবে।
- খাওয়ার ইচ্ছা কমে যাবে।
- ঘুমাতে অসুবিধা হবে।
যদি আপনি আপনার শিশুদের মধ্যে এই উপসর্গ গুলো লক্ষ্য করেন, তাহলে আপনাকে নিশ্চিত হতে হবে যে, আপনার শিশু জ্বরে আক্রান্ত হয়েছে। আর তখনই আপনাকে বাচ্চাদের হঠাৎ জ্বর হলে করণীয় কাজ গুলো সঠিক ভাবে ফলো করতে হবে। যা নিচে ধাপে ধাপে দেখিয়ে দেওয়া হলো।
বাচ্চাদের হঠাৎ জ্বর হলে করণীয় কাজগুলো
উপরের আলোচনা থেকে আমরা বাচ্চারের জ্বর হওয়ার কারণ ও তার উপসর্গ গুলো সম্পর্কে জানলাম। তবে এরপর আপনার বাচ্চাদের হঠাৎ জ্বর হলে করণীয় কি তা জেনে নেওয়াটা অত্যন্ত জরুরী। আর তখন আপনাকে আপনার বাচ্চার জ্বর কমানোর জন্য বেশ কিছু কাজ করতে হবে। যেমন-
১। ঘরের পরিবেশ ঠান্ডা রাখুন
অনেক অভিভাবক আছেন, যারা শিশুদের ঘর বন্ধ করে দিয়ে ঠান্ডা থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করেন। কিন্তু এমনটা করা ঠিক নয়। বরং, শিশুদের ঘরটি খোলামেলা রাখা উচিত যাতে পর্যাপ্ত আলো বাতাস চলাচল করতে পারে। ঠান্ডা বাতাস শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে এবং শিশুদের সর্দি-কাশি কমাতে সাহায্য করে। তবে ভুলেও শিশুদের কম্বল দিয়ে মুড়িয়ে রাখবেন না।
২। শিশুদের সুতি ও হালকা পোশাক পরিধান
শরীরের অতিরিক্ত তাপ বের করে দেওয়ার মাধ্যমে জ্বর কমে। তবে যখন শিশুকে মোটা পোশাক পড়ানো হয়, তখন শরীরের তাপ বের হতে বাধা পায় এবং জ্বর আরও বেড়ে যেতে পারে। এছাড়াও জ্বরের সময় শিশুরা সাধারণত অস্বস্তি বোধ করে। আর মোটা পোশাক পড়লে তাদের অস্বস্তি আরও বেড়ে যায়। তবে হালকা পোশাক শরীরের তাপ বের হতে সাহায্য করে, ফলে শিশুদের জ্বর দ্রুত কমে যায়।
৩। শিশুর পানিশূন্যতা প্রতিরোধ করুন
জ্বরের সময় শিশুরা বেশি ঘামে, বমি করে এবং ডায়রিয়া হয়ে থাকে। এর ফলে তাদের শরীর থেকে প্রচুর পরিমাণে তরল বেরিয়ে যায়। তাই যদি তাদের পর্যাপ্ত তরল পান না করা হয়, তাহলে তারা পানিশূন্যতায় ভুগতে শুরু করবে। আর এই পানিশূন্যতা একটি গুরুতর অবস্থা যা মৃ*ত্যুর কারণও হতে পারে।
আমরা জানি, তরল শরীরকে ঠান্ডা রাখতে সাহায্য করে। যখন শিশুরা পর্যাপ্ত তরল পান করে, তখন তাদের ঘাম বের হয়, যা শরীরের তাপমাত্রা কমাতে সাহায্য করে। এছাড়াও তরল শরীর থেকে বিষাক্ত পদার্থ বের করে দিতে সাহায্য করে এবং সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি সরবরাহ করে।
৪। শিশুদের বিশ্রামে রাখুন
জ্বরের সময় শরীরকে বিশ্রাম দেওয়া খুবই জরুরি। কারণ, জ্বর শরীরের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য শক্তির ব্যবহার করে। তাই যখন শিশুরা বিশ্রামে থাকে, তখন তার শরীর শক্তি সংরক্ষণ করতে পারে এবং রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সক্ষম হয়।
তাই জ্বরের সময় শিশুকে যতটা সম্ভব শুইয়ে রাখা উচিত। এতে তার শরীর বিশ্রাম নিতে পারবে এবং দ্রুত সেরে উঠতে পারবে। যদিওবা শিশুরা এই বিষয়টি বুঝবেনা, তবে একজন অভিবাবক হিসেবে আপনার এই বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে।
বাচ্চাদের জ্বর হলে কখন ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিত?
দেখুন, আমাদের শিশুরা অসুস্থ হলে অবশ্যই ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিত। তবে সবসময় যে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে বিষয়টা এমন নয়। বরং বিশেষ কিছু পরিস্থিতি আছে তখন অবশ্যই আমাদের শিশুদের সুস্থতার জন্য ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। আর সেই পরিস্থিতি গুলো নিচে দেওয়া হলো। যেমন,
- ৩ মাসের কম বয়সী শিশুর জ্বর হলে দ্রুত ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া উচিত।
- শিশুদের ১০৩°F (৩৯.৪°C) বা তার বেশি জ্বর হলে।
- জ্বর ২৪ ঘণ্টার বেশি স্থায়ী হলে।
- জ্বরের সাথে অন্যান্য লক্ষণ থাকলে যেমন, কাশি, সর্দি, শ্বাসকষ্ট, বমি, ডায়রিয়া, খিঁচুনি, ঘুম থেকে না জাগা, কানে ব্যথা, ঘাড় শক্ত হয়ে যাওয়া ইত্যাদি।
- যদি শিশু খুব অসুস্থ বোধ করে, তরল পান করতে অনীহা প্রকাশ করে, খাবার খেতে না চায় বা খুব বেশি ঘুমায়।
তো বাচ্চাদের হঠাৎ জ্বর হলে করণীয় কাজ গুলো করার পরও যদি আপনার বাচ্চার মধ্যে উপরোক্ত লক্ষন গুলো দেখা যায়, তাহলে অবশ্যই আপনাকে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। অন্যথায়, এই ছোটো পরিস্থিতি গুলোই পরবর্তীতে বড় আকার ধারন করবে।
শিশুদের জ্বর হলে কোন কাজ করা যাবে না?
এতক্ষন ধরে আমরা বাচ্চাদের হঠাৎ জ্বর হলে করণীয় কি সে সম্পর্কে জানলাম। তো শিশুদের জ্বর হলে আমরা অনেকেই ভুল কিছু কাজ করে ফেলি। এরফলে আমাদের শিশুদের জ্বর তো কমেই না, উল্টো তাদের জ্বর আরো বেশি হয়। তাই আপনিও এই ধরনের কাজ করা থেকে বিরত থাকবেন। যেমন,
- শিশুদের ঠান্ডা পানিতে ভেজা কাপড় দিয়ে শরীর মুছে দিবেন না।
- কোনো ধরনের অ্যালকোহল দিয়ে শরীর মুছে দিবেন না, এটা খুব বিপদজ্জনক।
- ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ সেবন করাবেন না।
- জ্বর হলে শিশুদের রাতে না খাইয়ে রাখবেন না।
- জোর করে শিশুদের গোসল করা বন্ধ রাখবেন না।
তো আপনার শিশুর জ্বর হলে আপনার যেসব কাজ করা উচিত না সেগুলো উপরে শেয়ার করা হয়েছে। আর আপনিও এই ধরনের কাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখবেন।
বহুল জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন ও উত্তর সমূহ
বাচ্চাদের হঠাৎ জ্বর হলে করণীয় বিষয় নিয়ে আপনার মনে বেশ কিছু পশ্ন থাকতে পারে। তবে চলুন জেনে নেওয়া যাক সেই সকল প্রশ্ন ও তার উত্তর-
শরীরের তাপমাত্রা কত ফারেনহাইট হলে জ্বর ধরা হয়?
মানুষের স্বাভাবিক শরীরের তাপমাত্রা ৩৭°C (৯৮.৬°F) এর কাছাকাছি থাকে। যখন শরীরের অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা ৩৮°C (১০০.৪°F) এর বেশি বেড়ে যায়, তখনই আমরা বলি জ্বর হয়েছে।
শিশুর তাপমাত্রা ১০০ হলে কি স্বাভাবিক?
১০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট (৩৭.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস) তাপমাত্রা শিশুদের জন্য সামান্য জ্বর বলে বিবেচিত হয়। তবে, শিশুর বয়স, অন্যান্য লক্ষণ এবং তাপমাত্রা কতক্ষণ ধরে টিকে আছে তার উপর নির্ভর করে এর অর্থ ভিন্ন হতে পারে।
উপসংহার
পাঠক, আপনার প্রিয় শিশুর জ্বর হলে আপনাকে কি কি করতে হবে সেগুলো নিয়ে আজকে বিষদভাবে আলোচনা করা হয়েছে। যে নিয়ম গুলো ফলো করার মাধ্যমে আপনি আপনার বাচ্চার হঠাৎ জ্বর নিরাময় করতে পারবেন। এছাড়াও আপনার জ্ঞানকে প্রসারিত করতে জন্ডিস হলে কি কি সমস্যা হয় এই পোস্টটি পড়তে পারেন।
“বাচ্চাদের হঠাৎ জ্বর হলে করণীয়” বিষয় গুলো সম্পর্কে আপনার যদি কিছু জানার থাকে তাহলে আপনি এই পোস্টের নিচে মন্তব্য করতে পারেন। এছাড়াও এই পোস্ট-টি তথ্যবহুল মনে হলে আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করতে পারেন। ধন্যবাদ।