সর্দির সাথে নাক দিয়ে রক্ত পড়ার কারণ স্বাভাবিক ঘটনা হলেও যদি দীর্ঘস্থায়ী হয় তাহলে অবশ্যই সিরিয়াসলি নিতে হবে। ঠাণ্ডা-কাশি,সর্দি-কাশি, ঠাণ্ডা লাগা বা সর্দি-জ্বর এক ধরনের ভাইরাসঘটিত সংক্রামক রোগ যা মানবদেহের ঊর্ধ্ব শ্বাসপথ বিশেষ করে নাকে আক্রমণ করে থাকে। এছাড়া এই রোগে গলবিল, অস্থিগহ্বর ও স্বরযন্ত্রও আক্রান্ত হতে পারে। ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হবার দুই দিন পর বা তারও আগেই এই রোগের লক্ষণ ও উপসর্গগুলি প্রকাশ দেখা দিতে পারে। ঠান্ডা লাগা ছাড়াও অনেক ধরনের অসুখ, ভাইরাস জ্বর বা ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ অথবা অ্যালার্জির কারণেও সর্দি লাগতে পারে।
তবে ঠান্ডায় সর্দি লাগার ব্যাপারটা একটু আলাদা। সহজেই বোঝা যায় যে এটা ঠান্ডা আবহাওয়ার একধরনের প্রতিক্রিয়া। নাকের ভেতর আছে পাতলা শ্লৈষ্মিক ঝিল্লি। এদের থাকে শ্লেষ্মানিঃসরণ ঝিল্লি ও গবলেট নামের ছোট ছোট কোষ যারা শ্লেষ্মার একটি উপাদান নিঃসরণ করে থাকে। যখন ঠান্ডা বাতাস নাকে যায় তখন নাকের স্নায়ুগুলো শ্লৈষ্মিক ঝিল্লিকে উজ্জীবিত করে থাকে। এরা ঠান্ডা বাতাসের আবির্ভাবের খবর মস্তিষ্কে পাঠায় আর সেখান থেকে সংকেত যায় আবার সেই ঝিল্লিগুলোতে। এরই ফলাফল হলো নাকে পানি বা তরল শ্লেষ্মা ঝরা যাকে আমরা সর্দি বলি এটা স্বয়ংক্রিয় প্রতিবর্তী (রিফ্লেক্স) ক্রিয়া। নাকের ভেতরের আবরণের উষ্ণতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে শ্লৈষ্মিক ঝিল্লি অবদান রাখে। ঠান্ডা বাতাস শ্লৈষ্মিক ঝিল্লিতে অস্বস্তি সৃষ্টি করে বলে এ রকম হয়ে থাকে।
সর্দি লাগা কি?
মানব দেহের একটি বিশেষ ইন্দ্রিয় হলো নাক। এই নাকেই হতে পারে নানা সমস্যা। এর মধ্যে একটি হলো নাক দিয়ে রক্ত পড়া। তবে নাক দিয়ে রক্ত পড়া কোনো রোগ নয় বরং এটি বিভিন্ন রোগের লক্ষণ মাত্র। সর্দির সাথে রক্ত আসা এই সমস্যাটা শুরু হয় বিশেষ করে শীতের সময়। সর্দিজ্বর সংক্রমিত থাকা অবস্থায় নাসারন্ধ্রের ভেতরে মিউকাস লাইনিং অতিক্রম করে প্রবেশ করে সংক্রমণকারী জীবাণু। এর ফলে নাাসরন্ধ্রের ভেতর অতিরিক্ত সর্দি জমা হয়। ডাক্তারি শাস্ত্র যেটিকে ‘রাইনোরেয়াা’ বলে। একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির বছরে ৪ থেকে ৬ বার এবং একটি শিশুর বছরে ১০ থেকে ১২ বার সর্দিজ্বর হওয়া একটি স্বাভাবিক বিষয়। আপনার জীবদ্দশায় ২০০ বারের বেশি সর্দি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এই সর্দিজ্বর বা ঠান্ডা লাগার কারন ভাইরাস সংক্রমণ। সর্দি-কাশি, ঠাণ্ডা-কাশি, ঠাণ্ডা লাগা বা সর্দি-জ্বর এক ধরনের ভাইরাসঘটিত সংক্রামক রোগ যা মানবদেহের ঊর্ধ্ব শ্বাসপথ, বিশেষ করে নাকে আক্রমণ করে।
সর্দির সাথে নাক দিয়ে রক্ত পড়ার কারণ?
আমরা এতক্ষণ নাক দিয়ে রক্ত পড়া কি? কাদের ক্ষেত্রে এই সমস্যা বেশি হয় তা জানলাম। এখন আমরা জানবো নাক দিয়ে রক্ত পড়ার কারণ গুলো কি কি। বেশিরভাগ সময়ই নাক দিয়ে রক্ত পড়ার সঠিক কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। এই ধরনের এই অ্যাপিসট্যাক্সিসকে ডাক্তারি ভাষায় বলা হয় প্রাইমারি অ্যাপিসট্যাক্সিস। সাধারণত ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ বা তার চেয়েও বেশি সময় এই প্রাইমারি অ্যাপিসট্যাক্সিসই হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে নাক দিয়ে রক্তক্ষরণের কারণ জানা যায়। চলুন দেখি সর্দির সাথে নাক দিয়ে রক্ত পড়ার কারণ কি কি।
১। উচ্চ রক্তচাপ
উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের মাঝে মাঝে নাক দিয়ে রক্তপাতের ঘটনা ঘটে থাকে। নাক দিয়ে রক্তক্ষরণের একটি প্রধান কারণ হলো উচ্চ রক্তচাপ। এতে শুরুতেই আতঙ্কিত হওয়া উচিত নয়। দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিলে এই সমস্যা থেকে দ্রুত মুক্তি পাওয়া সম্ভব। কিন্তু উচ্চ রক্তচাপের রোগীরা নাকে রক্ত দেখে আরো বেশি আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। তখন তার রক্তচাপ আরও বেড়ে যায়। যার ফলে রক্ত পড়া যেখানে কমে যেত, কিন্তু সেখানে সমস্যাটা আরো বেড়ে যায়।
২। জন্ডিস বা লিভারের সমস্যা থেকে
কারো কারো সর্দি কাশি জন্ডিসের সমস্যা থাকলে তার নাক দিয়ে হঠাৎ করেই রক্তক্ষরণ হতে পারে। এছাড়াও লিভার সিরোসিসের মত রোগে আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রেও নাক দিয়ে রক্ত পড়ার সমস্যাটি স্বাভাবিক।
৩। রক্তনালীর সমস্যার কারনে
আমাদের শরীরে অনেক রক্তনালী আছে। এসব রক্তনালীতে নানা ধরনের সমস্যা হতে পারে। এরকম রক্তনালীর অনেক সমস্যার জন্য নাক দিয়ে রক্ত ঝরতে পারে। এছাড়া রক্তনালীতে জন্মগত ত্রুটি অ্যাপিসট্যাক্সিসের একটি কারণ হতে পারে।
৪। ব্লাড থিনার/থিনিং ড্রাগ
বর্তমানে প্রায় বেশিরভাগ বয়স্ক ব্যক্তিরা অনেক রোগ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য ব্লাড থিনার ড্রাগ গ্রহন করে থাকেন। যেমন Aspirin/Warfarin জাতীয় ঔষধ। এসব ওষুধের অতিরিক্ত গ্রহনের কারনে নাক দিয়ে রক্ত ঝরতে পারে।
৫। রক্তের বিভিন্ন রোগ
নানান ধরনের রক্তের রোগ যেমন হিমোফিলিয়া,অ্যানিমিয়া,থ্রম্বোসাইটোপেনিয়া, পারপুরা ইত্যাদির রোগ হলে নাক থেকে রক্তক্ষরণ হতে পারে। এসব সমস্যার জন্য নিয়মিত রক্তক্ষরণ দেখা যায়।
৬। টিউমার
মাঝে মধ্যে আমাদের শরীরের বিভিন্ন অংশে টিউমার হয়ে থাকে। এটি মানব দেহের একটি খুবই স্বাভাবিক সমস্যা। নাকে যদি এমন কোন টিউমার হয়ে থাকে তাহলে তার কারণেও নাক থেকে রক্ত ঝরে।
৭। সাইনোসাইটিস
সাইনাসের ভিতরের জিল্লির মধ্যে প্রদাহ হওয়াকে সাইনোসাইটিস বলা হয়। সাইনোসাইটিসের হলে রোগী অনেক ধরনের সমস্যায় ভুগেন। যেমন সারাক্ষণ কপালে অস্বস্তি, মাথায় অস্বস্তি,নাকের মধ্যে ভারি ভারি লাগা, নাক বন্ধ হয়ে যাওয়া ইত্যাদি। এই সাইনোসাইটিস হলেও মাঝে মাঝে রোগির নাক থেকে রক্ত পড়তে পারে।
৮। নাকের ক্যান্সার
নাকের ভিতরে হওয়া ক্যান্সারের জন্য নাক থেকে রক্ত বের হতে পারে। এছাড়া শরীরের অন্য কোথাও ক্যান্সার থাকলেও নাক থেকে রক্ত পড়াটা একটা লক্ষন হিসেবে কাজ করে থাকে।
৯। নাকের মাঝখানের হাড় বাকা হলে
কখনো যদি কারো নাকের মাঝখানে হাড় অতিরিক্ত বাঁকা হয়ে যায় তাহলেও অ্যাপিসট্যাক্সিসের মত সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাছাড়া নাকের মধ্যে যে পর্দা থাকে সেটিতে কোন কারনে ছিদ্র হলে নাক থেকে রক্ত ঝরতে পারে।
১০। আঘাত
নাকে বিভিন্ন কারণে আঘাত লাগতে পারে। যেমন ঘুষি, নাকের মধ্যে আঙ্গুল দিয়ে খোঁচানো,সড়ক দুর্ঘটনা,কোন কিছুর সাথে ধাক্কা লাগা ইত্যাদি। এসব আঘাতের কারণে নাক দিয়ে রক্ত আসতে পারে। মাঝে মাঝে মাথায় জোরে আঘাত লাগলেও নাক দিয়ে রক্ত বের হতে পারে।
১১। মাদক সেবন
অতিরিক্ত ধূমপান বা মদ্যপান করলে শরীরের অন্যান্য অনেক সমস্যার সাথে নাক দিয়ে রক্ত ঝরতে পারে।
বহুল জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন ও উত্তর সমূহ
সর্দির সাথে নাক দিয়ে রক্ত পড়ার কারণ এই বিষয়ে আপনার মনে বেশ কয়েকটি প্রশ্ন থাকতে পারে। তবে চলুন জেনে নেই সেই সকল সমস্ত সকল প্রশ্ন ও উত্তর-
সর্দির ঔষধ খেলে কি নাক দিয়ে রক্ত পড়তে পারে?
ঠাণ্ডা এবং অ্যালার্জির ওষুধ যেমন ডিকনজেস্ট্যান্ট, অ্যান্টিহিস্টামাইন এবং ওষুধযুক্ত অনুনাসিক স্প্রে এড়ানোর চেষ্টা করুন। এই ওষুধগুলি অ্যালার্জির লক্ষণগুলি নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করতে পারে যা নাক দিয়ে রক্তপাতের ঝুঁকি কমাতে পারে। যাইহোক এগুলি প্রায়শই ব্যবহার করলে নাকের ভিতরের অংশ শুকিয়ে যেতে পারে এবং রক্তপাত হতে পারে ।
নাক দিয়ে রক্ত পড়া কি সর্দির লক্ষণ?
বিভিন্ন কারনে নাক দিয়ে রক্ত পড়তে পারে। তার মধ্যে অ্যালার্জি, সর্দি, হাঁচি বা সাইনাসের সমস্যার কারণে জ্বালাপোড়া । খুব ঠান্ডা বা শুষ্ক বাতাস। খুব জোরে নাক ফুঁকানো, বা নাক তোলা ইত্যাদি। নাক দিযে রক্ত পড়া সর্দির লক্ষন নয়।
উপসংহার
বারবার যদি আপনার নাক দিয়ে রক্ত পড়তে থাকে মানে আপনার নাশিকা গ্রন্থী বা নাক যদি রক্তাক্ত হয়ে থাকে সে ক্ষেত্রে কিন্তু অনেকটা ক্ষতি হবে সেজন্য আপনাদের গুরুত্ব দিতে হবে যেন সেখানকার আঘাতটা বা ক্ষতটা তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে যায়। এ সমস্যা সমাধানের জন্য অবশ্যই শীতকালে আপনাদের ইনহেলার ব্যবহার করতে হবে যাদের অতিরিক্ত শ্বাসকষ্ট থাকে তাদের জন্য। গরম কাপড় ব্যবহার করতে হবে আবার সব সময় আপনাদের চা কফি গরম খাবার খেতে হবে। বেশি ঠান্ডা লাগানো যাবে না যাদের ধুলাবালিতে থাকলে সমস্যা হয় তারা বেশি ধুলোবালি মধ্যে যাবেন না।
শীতের সময় মানুষের এতটাই নাকের সমস্যা হয় যে তারা যদি নিচের দিকে মাথা হেলিয়ে বসে থাকে সেক্ষেত্রে তাদের নাক দিয়ে রক্ত পড়ে তবে এটা কিছু কিছু মানুষের জীবন যাপনের বাজে অভ্যাসের সমস্যার জন্যই হয়ে থাকে। তাই এমন সমস্যা দেখা দিলে আপনারা অবশ্য বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করবেন এবং যোগাযোগ করার পরে চিকিৎসা গ্রহণ করবেন। যখন আপনি ডাক্তারের কাছে গিয়ে চিকিৎসা নিতে থাকবেন তখন অল্প সময়ের মধ্যে আপনার এটা ভালো হয়ে যাবে কিন্তু আপনি যদি চিকিৎসা না নেন তাহলে প্রতিবছরই শীতের সময় আপনার এই সমস্যাটা বার বার দেখা দিবে। তাই সর্দির সাথে নাক দিয়ে রক্ত পড়ার কারণ ভালোভাবে জেনে সেভাবে চিকিৎসা নেওয়া উচিত। এছাড়াও আপনার জ্ঞানকে প্রসারিত করতে মোটা হওয়ার জন্য খাদ্য তালিকা সম্পর্কে পড়তে পারেন।
“সর্দির সাথে নাক দিয়ে রক্ত পড়ার কারণ” এই বিষয়ে আপনার যদি কিছু জানার থাকে তবে আপনি এই পোস্টের নিচে মন্তব্য করতে পারেন। এছাড়াও এই পোস্ট-টি তথ্যবহুল মনে হলে আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করতে পারেন। ধন্যবাদ।