কোন জাতের গাভী সবচেয়ে বেশি দুধ দেয় সে সম্পর্কে জানা গাভীর খামার করার প্রধান শর্ত। গাভীর খামার আমাদের দেশের দুধ উৎপাদনের সবচেয়ে বড়ো মাধ্যম। বাংলাদেশে প্রান্তিক পর্যায়ে থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ পর্যায়ে দুগ্ধজাত গাভীর খামার হচ্ছে। দেশের শীর্ষস্থানীয় খামার গুলো তে বানিজ্যিকভাবে দুধ উৎপাদনের লক্ষ্যে গাভী পালন করা হচ্ছে খামারের মাধ্যমে। এই ধরণের বানিজ্যিক খামার গুলো পরিচালিত হয় উন্নত জাতের গাভী নিয়ে, সেগুলোর পরিচর্যা করে অধিক পরিমাণে দুগ্ধ উৎপাদন করা হয়। শুধু বড়ো আকারের বানিজ্যিক খামার গুলোতেই না, বরং ছোট আকারের গ্রামীণ খামার গুলোও এখন উন্নত জাতের গাভী পালনে মনযোগী হয়েছে। আজকে আমরা কোন জাতের গাভী সবচেয়ে বেশি দুধ দেয় তাদের নিয়ে বিস্তারিত জানবো।
উন্নত জাতের গাভী চেনার উপায়
উন্নত জাতের গাভী চেনার কিছু নির্দিষ্ট উপায় আছে। শুধু বিদেশী উন্নত জাতের গাভী না, দেশীয় উন্নত জাতের পাশাপাশি সংকরায়নের মাধ্যমে এখন বিভিন্ন জাতের সংকর গাভীর দুধ উৎপন্ন করা যায় উচ্চহারে। গাভীর বংশ, প্রজনন ইতিহাস, ওলান, শারিরীক সুস্থতা, খাদ্য গ্রহণ ইত্যাদি নির্ভর করে একটা উন্নত গাভী নির্বাচনে। কোন জাতের গাভী সবচেয়ে বেশি দুধ দেয় তা জানার ক্ষেত্রে এই লক্ষ্মণ গুলো সম্পর্কে অবগত থাকা জরুরি। দেশে প্রতি বছর ১ কোটি ৫৬ লক্ষ লিটার দুধের চাহিদা রয়েছে। চাহিদার সিংহভাগ দেশেই পূরণ হলেও বড় একটা অংশের ঘাটতি থাকে উৎপাদনে। সুতরাং, দুধ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখনো স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারে নাই। দেশে দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার তৈরিতে উন্নত জাতের গাভী পালনের বিকল্প নাই।
কোন জাতের গাভী সবচেয়ে বেশি দুধ দেয়?
গরুর দুধ আমাদের দেহের জন্য অত্যান্ত পুষ্টিকর ও গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। তাই গরু পালনের ক্ষেত্রে আমাদের লক্ষ্য করা উচিত কোন গরু বেশি দুধ দিতে সক্ষম। কোন জাতের গাভী সবচেয়ে বেশি দুধ দেয় তা নিচের আলোচনায় বিস্তারিত তুলে ধরা হল-
১. হোলস্টেইন ফ্রিজিয়ান

দুগ্ধখামার তৈরির ক্ষেত্রে হোলস্টাইন ফ্রিজিয়ান গাভী গুলো সারাবিশ্বে সবচেয়ে জনপ্রিয় ও উন্নত মানের জাত হিসেবে গবেষণায় পরিচিত। নেদারল্যান্ডসের ফ্রিজল্যান্ড ও জার্মানির হোলস্টেইন অঞ্চলে উৎপত্তি এই গাভীর। আকারে বিশালদেহী, সাদা-কালো ও সাদা-লাল বর্ণের এই গাভী দুগ্ধখামারে অত্যন্ত পরিচিত। সাধারণত একটি হোলস্টেইন ফ্রিজিয়ান গাভী ২৫-৩৫ লিটার দুধ দিতে সক্ষম। তবে কিছু কিছু অতি উন্নত ভার্সনের ৪৫ কেজি পর্যন্ত দুধ দিতেও সক্ষম। এই গাভী গুলো অত্যন্ত শান্ত। একটি পূর্ণ বয়স্ক ফিজিয়ান গাভীর ওজন ৬৫০-৮০০ কেজি হতে পারে। তবে গাভীর এই দুধ দেওয়ার ক্ষমতা তার বয়স, খাদ্য, স্বাস্থ্য ও পুষ্টির ওপর নির্ভরশীল।
২. জার্সি

ফ্রিজিয়ানের পর সবচেয়ে জনপ্রিয় ও উন্নত দুগ্ধজাত গাভীর জাতটি হচ্ছে জার্সি। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের মধ্যবর্তী জার্সি দ্বীপে এই গাভী পাওয়া গেলেও এখন সারাবিশ্বে পালন করা হয় দুধের জন্য। আকারে ফ্রিজিয়ানের চেয়ে একটু ছোট এই গাভীর ওজন পূর্ণবয়স্ক অবস্থায় ওজন ৩৫০-৫০০ কেজি৷ শ্যামলা, বাদামী, মুখের অংশ সাদা এবং নাকের অংশ লাল রঙের হয়ে জার্সি গাভীর। এদের পিঠের শিরদাঁড়া সোজা ও ঘাড়ের দিক থেকে কৌণিক আকৃতির। একটি সুস্থ পূর্ণবয়স্ক জার্সি গাভী প্রতিদিন ১৫-২৫ লিটার দুধ দিতে সক্ষম। তবে আবহাওয়া, স্বাস্থ্য, সময়ের ওপর দুধের পরিমাণ নির্ভরশীল। যেকোনো আবহাওয়ায় মানিয়ে নিতে সক্ষম হওয়ায় জার্সি গাভীর বিশ্বব্যাপী ব্যপক চাহিদা আছে।
৩. রেড বা লাল সিন্ধি

পাকিস্তানের সিন্ধু নদী তীরবর্তী সিন্ধু প্রদেশে এই গরুর আদিনিবাস। সেই জন্যই এর নামের সাথে ‘সিন্ধি’ শব্দ যুক্ত আছে। বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে ব্রাউন সুইচ, ড্যানিশ রেড ও হোলস্টেইন ফ্রিজিয়ান জাতের সংমিশ্রণের মতো এই জাতটি আছে। রেড সিন্ধি শুধু দুধ না বরং মাংসের জন্যও অত্যন্ত জনপ্রিয়। বাংলাদেশ সহ ভারতীয় উপমহাদেশের জন্য এই গরুর জাতটি খুবই উপযোগী। গাড়ো লাল রঙের রেড সিন্ধির ওজন ৩০০-৪০০ কেজি হয় এবং দৈনিক ১২-২০ লিটার দুধ প্রদান করে থাকে। তবে গরুর স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও অবস্থার ওপর এই পরিমাণ নির্ভরশীল।
৪. শাহীওয়াল

দুধ উৎপাদনের জন্য শাহিওয়াল সারা বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও উন্নত জাতের একটি। পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের শাহিওয়াল জেলায় আদিনিবাস হওয়ায় এই জাতটি শাহিওয়াল হিসেবেই নামকরণ করা হয়েছে। তবে, শুধু দুধ উৎপাদন না, বরং মাংস উৎপাদনের ক্ষেত্রে শাহিওয়াল দেশের খামারিদের কাছে খুবই চাহিদাসম্পন্ন একটি জাত। শাহিওয়াল গাড়ো লাল, সোনালী বা বাদামী রঙের হয়ে থাকে। কাঁধের কুঁজ সোজা, শিং গুলো ছোট ও মোটা আকৃতির হয়। আবার গলার চামড়া নিচের দিকে অনেকটা ঝুলে থাকে। একটি শাহিওয়াল গাভীর ওজন প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় ৪৫০ কেজি পর্যন্ত হতে পারে। উন্নত ও সুস্থ একটি গাভী দৈনিক প্রায় ২৫ লিটার হয়ে থাকে। সাধারণত স্বাভাবিকভাবেই ১২-১৮ লিটার হয়ে থাকে অবশ্যই। তবে সবকিছুই গাভীর পুষ্টিগুণ, স্বাস্থ্য ও অবস্থার ওপর নির্ভরশীল।
৫. গির

গির জাতের গাভী দেশের খুবই উন্নত জাতের একটা গরুর অন্যতম। প্রতিটি ডেইরি ফার্মে গির জাতের গরুর থাকার সম্ভাবনা প্রায় শতভাগ। বাংলাদেশ সহ ভারতীয় মহাদেশের উষ্ণ কিংবা নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ায় গির পালন অনেক উপযোগী কারণ গিরের আদিনিবাস ভারতের গুজরাট অঞ্চলে। লালচে বাদামী, কখনো কখনো কালো রঙের গির জাতের গরু তে শিং গুলো অনেক বড়ো হয় শাহিওয়ালের তুলনায়। বড়ো হওয়ায় পিছনে দিকে চলে যায় শিং গুলো। শাহিওয়ালের মতো গিরের ও কুঁজ থাকে। তবে মাথা ও কান তুলনামূলক বড়ো আকৃতির থাকে, আবার গলার নিচের চামড়া অনেকটা ঝুলে থাকে। লম্বায় সাড়ে চার ফুটের মতো হয়ে থাকে গির। গিরের মাধ্যমে শাহীওয়াল ও ফ্রিজিয়ান জাতের উন্নয়ন চলছে সংকরায়নের মাধ্যমে। একটি গিরের ওজন পূর্ণবয়স্ক, সুস্থ অবস্থায় ৪০০ কেজি ও ১২-২৫ লিটার দুধ প্রদান করে দৈনিক। তবে কিছু কিছু গাভী ৪০-৫০ লিটার ও দুধ প্রদান করে।
৬. রথী গাভী

রথী ভারতের রাজস্থান, জয়সলমীর এলাকায় পাওয়া যায়। দুধ উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত রথী প্রতিদিন ১৫ লিটার পর্যন্ত দুধ দিয়ে থাকে।
৭. উন্নত দেশি গাভী

বাংলাদেশের নিজস্ব রয়েছে কিছু উন্নত জাতের গাভী। দেশের গ্রামীণ পর্যায়ে এই জাতের গরু বেশি দেখা যায় বানিজ্যিক খামারের তুলনায়। এই ধরণের গাভী কে পুষ্টিকর খাবার, স্বাস্থ্য ও ভালো আবহাওয়ায় রাখলে ২-৩ লিটার দৈনিক দুধ দিতে পারবে।
৮. সংকর গাভী

আমাদের দেশে বর্তমান সংকর গাভী সবচেয়ে বেশি দেখা যায়৷ উন্নত জাতের ষাঁড় ও দেশি-বিদেশি গাভীর সংকরায়নে নতুন সংকর জাতের গাভীর উৎপত্তি হয়। এটি আমাদের দেশের আবহাওয়ার সাথে অনেকাংশে সহনশীল। সংকর গাভীর গড় ওজন ৩০০-৪০০ কেজি এবং দৈনিক গড়ে ১২-১৮ কেজি দুধ প্রদান করে থাকে।
বহুল জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন-উত্তর সমূহ
কোন জাতের গাভী সবচেয়ে বেশি দুধ দেয় এই বিষয়ে আপনার মনে বেশ কয়েকটি প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে? তাহলে চলুন জেনে নেই সেই সকল প্রশ্ন ও উত্তর।
বাংলাদেশের বাৎসরিক উৎপাদিত দুধের পরিমাণ কত?
বাংলাদেশে বাৎসরিক ১ কোটি ১৫ লক্ষ লিটার দুধ উৎপাদিত হয়। কোন জাতের গাভী সবচেয়ে বেশি দুধ দেয়, কোন জাতের গাভী পালন করা উচিত, তা এই পরিসংখ্যান থেকেই নির্বাচন করা উচিত।
কোন জাতের গরু সবচেয়ে বেশি দুধ উৎপাদন করে?
হলস্টাইন ফ্রিজিয়ান গাভী পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি গরুর দুধ উৎপাদন করে থাকে। বিশ্বে মোট দুধের প্রায় ৫০ শতাংশ আসে হলস্টাইন ফ্রিজিয়ান থেকে।
উপসংহার
উপরোক্ত আলোচনা থেকে কোন জাতের গাভী সবচেয়ে বেশি দুধ দেয়, কোন জাতের গাভীর বৈশিষ্ট্য কেমন, কোনটা বেশি উপযোগী তার বিস্তারিত জেনেছি। ইউনেস্কোর তথ্যানুযায়ী প্রতিটি মানুষের দৈনিক ২৫০ গ্রাম দুধ খাওয়া আবশ্যক। সুতরাং, দেশের মানুষের স্বাস্থ্য ও পুষ্টিগুণ বিবেচনায় দুধ উৎপাদনের গুরুত্ব কতটা তা প্রমাণিত। আবার দেশে দুধ উৎপাদনের মাধ্যমে দেশের পাশাপাশি বৈদেশিক আমদানি কমলেও এটি দেশের অর্থনীতি তে অনেক বড়ো অবদান রাখতে পারে। এছাড়াও আপনার জ্ঞানকে প্রসারিত করতে গরু মোটাতাজাকরণ দানাদার খাদ্য তালিকা সম্পর্কে পড়তে পারেন।
“কোন জাতের গাভী সবচেয়ে বেশি দুধ দেয়” এ বিষয়ে আপনার যদি কিছু জানার থাকে তবে আপনি এই পোস্টের নিচে মন্তব্য করতে পারেন। এছাড়াও এই পোস্ট-টি তথ্যবহুল মনে হলে আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ!