উন্নত জাতের ভুট্টার নাম জানা ভুট্টা চাষের অন্যতম পূর্বশর্ত। ভুট্টা বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান অর্থকরী ফসল। চাহিদা ও প্রয়োজন বিবেচনায় দেশে ভুট্টার ব্যপক চাহিদা আছে। শুধু ভুট্টা থেকে তৈরি করা সরাসরি খাদ্যের পাশাপাশি প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে মানুষের বিভিন্ন খাদ্যও উৎপাদন করা হয়। বাংলাদেশে মোট চাহিদার থাকা ভুট্টার অধিকাংশ আমদানি করা হয়৷ তবে যদি আমরা এই ভুট্টার প্রতি একটু আস্থাশীল হয়ে ভুট্টা চাষে আরও মনযোগী হয়, তাহলে আর সেই প্রয়োজনীয়তা হবে না। আমাদের দেশ খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার শর্তে ভুট্টার স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া অন্যতম প্রধান শর্ত। আজকের আর্টিকেলে আমরা উন্নত জাতের ভুট্টার নাম নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
উন্নত জাতের ভুট্টা কী?
উন্নত জাতের ভুট্টা হচ্ছে ভুট্টার আগের জাতের উন্নয়নের মাধ্যমে নতুন জাতের উদ্ভাবন করা, যা তুলনামূলক বেশি ফলন ও প্রতিকূল আবহাওয়া সহিষ্ণু। ফলে আমাদের দেশের ভুট্টার চাষ জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশে ভুট্টার চাষ বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশের আমদানি নির্ভরতা হ্রাস পাচ্ছে উল্লেখযোগ্য হারে। ফলে আমাদের দেশ উল্লেখযোগ্য ভাবে অর্থনৈতিক ভাবে লাভবান হয়। দেশে ভুট্টার চাহিদা প্রায় ৭০ লক্ষ টন প্রতি বছরে। অধিকাংশ দেশে চাষ হলেও একটা বড়ো অংশ আমদানি করা হয়।
উন্নত জাতের ভুট্টার নাম
ভুট্টা আমাদের আটা তৈরিতে অত্যান্ত সহায়ক। উন্নত জাতের ভুট্টা আমাদের অধিক ফলন দিয়ে থাকে। উন্নত জাতের ভুট্টার নাম বিস্তারিত আলোচনা তুলে ধরা হল –
খৈ ভুট্টা
দেশের উন্নত জাতের ভুট্টার মধ্যে খৈ ভুট্টা অন্যতম। এই জাতের ভুট্টা রবি মৌসুমে ১২৫-১৩০ দিন থাকে ফসল পাওয়ার জন্য। ফলন রবি মৌসুমে প্রতি হেক্টপ্রে ৩-৪ টন পাওয়া যায়। খরিফ মৌসুমে ৮০-৯০ দিনে ফলন পাওয়া যায় কিন্তু ফলন রবি মৌসুমের তুলনায় কমে ২.৫-৩.৫ টন পাওয়া যায় প্রতি হেক্টরে।
বর্ণালী ভুট্টা
উন্নত জাতের ভুট্টার মধ্য বর্ণালী জাতের একটি অন্যতম। রবি ও খরিপ মৌসুমে এই ভুট্টা চাষ করা যায়। রবি ও খরিপ মৌসুমে প্রতি হেক্টর প্রতি সময় লাগে ১৪০-১৪৫ দিন ও ৯৫-১০০ দিন। ফলন হয় প্রতি হেক্টরে ৫.৫-৬.০ টন রবি মৌসুমে ও খরিপভ ৪.৫-৫ টন।
মোহর ভুট্টা
মোহর একটি উন্নত জাতের ভুট্টার নাম। এই জাতটি রবি মৌসুমে ১৩৫-১৪৫ দিনে এবং খরিফ মৌসুমে ৯৫-১০৫দিনে পাকে। ফসলের পরিমাণ বিবেচনা করলে ফলন হেক্টরে রবি মৌসুমে ৫.০-৫.৫ টন এবং খরিফ মৌসুমে ৩.৫-৪.৫ টন হয়।
শুভ্রা ভুট্টা
শুভ্রা দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি ভুট্টার জাত। উন্নত জাতের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে জাতটি রবি মৌসুমে ১৩৫-১৪৫ দিনে এবং খরিফ মৌসুমে ৯৫-১১০ দিনে ফসল তোলার উপযোগী হয়। ফলন হয় প্রতি হেক্টরে রবি মৌসুমে ৪.৫-৫.৫ টন এবং খরিফ মৌসুমে ৩.৫-৪.৫ টন।
বারি হাইব্রিড ভুট্টা – ৩
বারি জাতের হাইব্রিড ভার্সনের একটি জাত এটি। বারি হাইব্রিড জাতের জীবনকাল ১৩৫-১৪৫ দিন এবং খরিপে ১১৫ দিন। এই জাতের ভুট্টার রবি মৌসুমে গড় ফলন ৯.৫-১০.০ টন প্রতি হেক্টর এবং খরিপ মৌসুমে ৭-৭.৫ টন প্রতি হেক্টরে।
বারি হাইব্রিড ভুট্টা – ৪
বারি জাতের চতুর্থ হাইব্রিড ভার্সন এটি। এ জাতের জীবনকাল রবি মৌসুমে ১৩৫-১৪৫ দিন এবং খরিপে ১১৫ দিন। জাতের গড় ফলন হচ্ছে রবি মৌসুমে গড়ে ৭.৪-৯.৫ টন প্রতি হেক্টরে, আর খরিপ মৌসুমে ৭.৫-৮.৫ টন হেক্টর প্রতি।
বারি হাইব্রিড ভুট্টা – ৫
বারি হাইব্রিড জাতের ৫ম ভার্সন এটি। বারি মৌসুমে এই জাতের জীবনকাল ১৩৫-১৪৫ দিন এবং খরিপ মৌসুমে ১১৫ দিন। বারি হাইব্রিড ভুট্টা – ৫ এর ফলন হেক্টরে রবি মৌসুমে ১০.০-১০.৫ টন ও খরিফ মৌসুমে ৭.০-৭.৫ টন।
বারি হাইব্রিড ভুট্টা – ৬
বারি হাইব্রিড ভুট্টা এর উন্নত জাতের ষষ্ঠ সংস্করণ হচ্ছে হাইব্রিড ভুট্টা ৬। বারি হাইব্রিড ৬ জাতের ভুট্টার জীবনকাল রবি মৌসুমে ১৪৪-১৪৮দিন ও খরিপ মৌসুমে ৯০-১১০ দিন। অন্যদিকে ফলন হচ্ছে জাতটির প্রত হেক্টরে রবি মৌসুমে ৯.৮-১০.০ টন. ও খরিপে ৮.০-৮.৫ টন।
বারি হাইব্রিড ভুট্টা – ৭
২০০৬ সালে আন্তর্জাতিক গম ও ভুট্টা উন্নয়ন কেন্দ্র হতে সংগ্রহীত হয়েছে ভুট্টার এই জাতটি। ভুট্টার বাছাইকৃত জাতের পিতৃ-মাতৃ লাইন হতে একমুখী সংকরায়ণের মাধ্যমে এই জাতটি উদ্ভাবিত হয়েছে। বারি হাইব্রিড ভুট্টা – ৭ এর জীবনকাল রবি মৌসুমে ১৩৫-১৪১ দিন ও খরিপ মৌসুমে ৯৫-১০০ দিন। ফলন প্রতি হেক্টরে রবি মৌসুমে ৮-৯ টন, খরিপে ৭.৫-৮.৫ টন।
বারি হাইব্রিড ভুট্টা – ৯
বারি হাইব্রিড জাতের নবম সংস্করণ এই জাত। এ জাতটির জীবনকাল রবি মৌসুমে ১৪৫-১৫০ দিন ও খরিপ মৌসুমে ১০৫-১১০ দিন। এই জাতটির দানা আকর্ষণীয় হলুদ রঙের। দানা ডেন্ট প্রকৃতির এবং হাজার দানার ওজন ৩৭০-৩৭৫ গ্রাম। হেক্টরপ্রতি ফলন রবি মৌসুমে ১১.৫-১২.৫ টন ও খরিপ মৌসুমে ১০.৫-১১.৫ টন। ২০০৭ সালে আন্তর্জাতিক গম ও ভুট্টা উন্নয়ন কেন্দ্র হতে সংগ্রহীত হয়েছে ভুট্টার এই জাত। বাছাইকৃত পিতৃ-মাতৃ লাইন হতে একমুখী সংকরায়ণ করে এ জাতটি উদ্ভাবিত করা হয়েছে।
বারি হাইব্রিড ভুট্টা – ১০
২০০৯ সালে আন্তর্জাতিক গম ও ভুট্টা উন্নয়ন কেন্দ্র হতে সংগ্রহ করা হয়েছে এই জাতটি৷ বাছাইকৃত পিতৃ-মাতৃ লাইন থেকে একমুখী সংকরায়ণ করে এ জাতটি উদ্ভাবিত করা হয়েছে। বারি হাইব্রিড ভুট্টা -১০ এর জীবনকাল রবি মৌসুমে ১৪৫-১৫০ দিন ও খরিপ মৌসুমে ১০০-১১০ দিন। জাতটির দানা আকর্ষণীয় হলুদ রঙের এবং আকৃতি ফ্লিন্ট এর মতো। হেক্টরপ্রতি ফলন রবি মৌসুমে ১০-১১.৫ টন, খরিপ মৌসুমে ১০-১১ টন।
বারি হাইব্রিড ভুট্টা – ১১
বারি হাইব্রিড ভুট্টা – ১১ জাতের জীবনকাল রবি মৌসুমে ১৫০-১৫৫ দিন, খরিপ মৌসুমে ১২০-১৩০ দিন। এই জাতটির দানা হলুদ রঙের, ফ্লিন্ট আকৃতির। হেক্টরপ্রতি ফলন রবি মৌসুমে ১০.৫-১১.৫ টন, খরিপ মৌসুমে ১০-১১ টন। ২০০৯ সালে আন্তর্জাতিক গম ও ভুট্টা উন্নয়ন কেন্দ্র হতে সংগ্রহীত হয়েছে। এটি একইভাবে বাছাইকৃত পিতৃ-মাতৃ লাইন হতে একমুখী সংকরায়ণ করে উদ্ভাবিত হয়েছে। পরে এটি অবমুক্ত করা হয়।
বারি হাইব্রিড ভুট্টা – ১২
সাদা দানা বিশিষ্ট ফ্লিন্ট প্রকৃতির জাত উন্নত জাত এটি। এটি ২০১৬ সালে অবমুক্ত করা হয়। এ জাতটির জীবনকাল রবি মৌসুমে ১৪০-১৪৫ দিন, খরিপ মৌসুমে ১২০-১৩০ দিন। খরা অবস্থায় একটি মাত্র সেচ প্রদানে জাতটির ফলন হেক্টরপ্রতি ৮-৮.৫ টন এবং স্বাভাবিক সেচ প্রয়োগে ফলন হেক্টরপ্রতি ১০-১১ টন। স্বল্প সেচে উৎপাদন ক্ষমতা এবং মধ্যমাত্রার খরা সহিষ্ণুতা এই জাতের প্রধান বিশেষত্ব। ২০১৬ সালে এটি অবমুক্ত করা হয় বাজারে।
বারি হাইব্রিড ভুট্টা – ১৩
বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১৩ অবমুক্ত করা হয় ২০১৬ সালে। এই জাতটির জীবনকাল রবি মৌসুমে ১৪৫-১৫২ দিন, খরিপ মৌসুমে ১২০-১৩৫ দিন। খরা অবস্থায় এই জাতের ফলন হেক্টরপ্রতি ৮.২-৮.৯ টন এবং স্বাভাবিক সেচ প্রয়োগে ফলন হেক্টরপ্রতি ১০.১-১১.২ টন। স্বল্প সেচে উৎপাদনক্ষমতা এবং মধ্যমাত্রার খরা সহিষ্ণুতা এই জাতের বিশেষত্ব। উচ্চ ফলনশীল এই জাত টি সাদা দানা বিশিষ্ট।
বারি হাইব্রিড ভুট্টা – ১৪
বারি হাইব্রিড ভুট্টা ১৪ এর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এ জাতটির জীবনকাল রবি মৌসুমে ১৪০ দিন এবং খরিফ মৌসুমে ১১৫ দিন। জাতটি দানা সাদা বর্ণের এবং সেমি ডেন্ট আকৃতির। পাতা ঝলসানো কিন্তু রোগ সহনশীল। হেক্টরপ্রতি গড় ফলন রবি মৌসুমে ১০.৮৪ টন এবং খরিফ মৌসুমে ১০.৫২ টন। ২০১৭ সালে বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১৪ অবমুক্ত করা হয়। খরিফ মৌসুমে অধিক তাপ সহিষ্ণু এবং মধ্যম ফলন ক্ষমতা সম্পন্ন এর অন্যতম প্রধাণ বিশেষত্ব।
বহুল জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন-উত্তর সমূহ
উন্নত জাতের ভুট্টার নাম এই বিষয়ে আপনার মনে বেশ কয়েকটি প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে? তাহলে চলুন জেনে নেই সেই সকল প্রশ্ন ও উত্তর।
বাংলাদেশের বাৎসরিক ভুট্টার চাহিদার কতটুকু ভুট্টা দেশে উৎপাদিত হয়?
বাংলাদেশে ৭০ লক্ষ টন ভুট্টার চাহিদার ৫৬ লক্ষ টন উৎপাদন হয়। সুতরাং উন্নত জাতের ভুট্টার নাম জেনে ভুট্টা চাষের কোনো বিকল্প নেই চাহিদা পূরণে।
ভুট্টার সবচেয়ে ফলনশীল জাত কোনটা?
উপরোল্লিখিত সব উন্নত জাতের ভুট্টার নাম সমূহ ভুট্টার ফলনশীল জাত। আবহাওয়া ও স্থান ভেদে নির্বাচন করতে পারে জাত।
উপসংহার
উপরোল্লিখিত আলোচনা থেকে উন্নত জাতের ভুট্টার নাম সম্বন্ধে বিস্তারিত জেনেছি আমরা। ভুট্টা আমাদের কত বড়ো রাষ্ট্রীয় সম্পদ তা এর চাহিদা ও গুরুত্ব থেকেই স্পষ্ট হওয়া যায়। সুতরাং উন্নত জাতের ভুট্টা চাষ করে, দেশের চাহিদা পূরণ করে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধ লাভ করানো উচিত আমাদের দেশের চাষিদের মুল লক্ষ্য। এছাড়াও আপনার জ্ঞানকে প্রসারিত করতে শীতকালীন সবজির নামের তালিকা সম্পর্কে পড়তে পারেন।
“উন্নত জাতের ভুট্টার নাম” এ বিষয়ে আপনার যদি কিছু জানার থাকে তবে আপনি এই পোস্টের নিচে মন্তব্য করতে পারেন। এছাড়াও এই পোস্ট-টি তথ্যবহুল মনে হলে আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ!