মানুষের মৌলিক অধিকার ৬টি কি কি এ সম্পর্কে প্রতিটি নাগরিকের জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। মর্যাদা পূর্ণভাবে বেঁচে থাকতে একজন মানুষের যেসব অধিকার প্রয়োজন তাই তো মানুষের মৌলিক অধিকার বা মানবাধিকার হিসেবে বিবেচিত হয়। একটি রাষ্ট্রের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে এসবের মধ্য থেকে কিছু অধিকারকে মৌলিক হিসেবে ঘোষণা করে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই মৌলিক অধিকার ভঙ্গ হলে রাষ্ট্র প্রতিকার দিতে বাধ্য থাকে।
মৌলিক অধিকার হল এমন অধিকার যা সকল মানুষের জন্য সার্বজনীন, সহজাত ও হস্তান্তরযোগ্য এবং যা এড়ানো যায় না। এই অধিকারগুলি প্রত্যেক মানুষের জন্মগতভাবে প্রাপ্য এবং এগুলিকে আইন দ্বারা রক্ষা করা হয়।
মৌলিক অধিকার কি?

যে সকল অধিকার মানুষের জন্মগত হতে প্রাপ্ত অর্থাৎ মানুষ জন্মের পর যে সব অধিকার পাবে তাকে বলে মৌলিক অধিকার। মৌলিক অধিকার হলো সেইসব অধিকার যা কোন দেশের নাগরিকদের জন্য সংবিধান কর্তৃক স্বীকৃত এবং যা বাস্তবায়নের জন্য সাংবিধানিক নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়। মৌলিক অধিকারগুলো সবই মানবাধিকার। তবে এই অধিকারগুলোকে মৌলিক অধিকার বলার কারণ হলো, যেহেতু সংবিধান দেশের সর্বোচ্চ আইন বা মৌলিক আইন এবং ঐ সংবিধানে সংযোজিত অধিকারগুলোও মৌলিক আইনেেই অংশ এবং এই অধিকারগুলোকে বিশেষ সাংবিধানিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রক্ষা করা হয় এবং পরিবর্তন করতে হলে স্বয়ং সংবিধানকে পরিবর্তন করতে হয়।
প্রতিটি দেশের সংবিধানেই মৌলিক অধিকারের বিষয়টি পরিস্কারভাবে উল্লেখ করা আছে। বাংলাদেশের সংবিধানের ২৬ থেকে ৪৭ (ক) অনুচ্ছেদগুলোই হলো মৌলিক অধিকার সংশ্লিষ্ট। সরকার বা সংসদ ইচ্ছা করলেই মৌলিক অধিকার বিরোধী আইন তৈরি করে এর ব্যাঘাত ঘটাতে পারবে না। মানুষের মৌলিক অধিকার ৬টি কি কি তা প্রতিটি নাগরিকের জানা থাকা দরকার।
মানুষের মৌলিক অধিকার ৬টি কি কি
প্রতিটি মানুষের সুন্দর ও আত্নসম্মানের সহিত জীবনযাপনের জন্য মৌলিক অধিকার ভোগ করা খুবই জরুরী। আজ আমরা মানুষের মৌলিক অধিকার ৬টি কি কি এই বিষয়ে আলোচনা করবো। মানুষের মৌলিক অধিকার ৬টি। যেমন – খাদ্য, বাসস্থান, পোশাক, শিক্ষা, চিকিৎসা ও নিরাপত্তা।
১। খাদ্য

মানুষের মৌলিক চাহিদার মধ্যে অন্যতম হলো খাদ্য। খাদ্য অধিকার একটি মৌলিক মানবাধিকার। এটি মানুষের সম্মানের সাথে খাদ্য গ্রহণের অধিকারকে রক্ষা করে। মানুষ যাতে মর্যাদার সঙ্গে নিজের ও পরিবারের খাদ্যের ব্যবস্থা করার সামর্থ্য অর্জন করতে পারে, তা নিশ্চিত করাই এর লক্ষ্য। এটি কোনো দান বা অনুগ্রহের বিষয় নয়, বরং মর্যাদার সাথে সকল মানুষের নিজেদের খাদ্যের সংস্থান করার সামর্থ্য অর্জনের নিশ্চয়তার সাথে জড়িত।
দেহের বৃদ্ধি, গঠন, ও শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করতে খাদ্য অপরিহার্য। সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্রে (১৯৪৮) খাদ্য অধিকারকে মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। বাংলাদেশ সংবিধান রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে খাদ্য অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে। জাতিসংঘের ১৯৬৬ সালে আন্তর্জাতিক চুক্তির ১১ অনুচ্ছেদের মাধ্যমে খাদ্য অধিকারকে বাধ্যতামূলক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। তাই খাদ্য প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার যার ব্যবস্থা করতে রাষ্ট্র অঙ্গিকারাবদ্ধ।
২। বাসস্থান

একটি নিরাপদ ও বাসযোগ্য বাসস্থান প্রত্যেক নাগরিকের মৌলিক অধিকার। গৃহহীনতা সত্যিই একটি অভিশাপ। বাসস্থান, আবাসন, গৃহায়ন, গৃহসংস্থান বা গৃহনির্মাণ বলতে মানুষের বসবাসের জন্য স্থায়ী ও নিরাপদ বসবাসের ব্যবস্থাকে বোঝায়। বেঁচে থাকার জন্য প্রতিটি মানুষের নিরাপদ বাসস্থানের প্রয়োজন। সার্বজনীন মানবাধিকার সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ঘোষণা ও দলিল অনুযায়ী প্রতিটি মানুষের প্রয়োজনীয় গৃহসংস্থানের অধিকার আছে যা রাষ্ট্র কর্তৃক ব্যবস্থা করতে বাধ্য। নিরাপদ বাসস্থান ঐতিহাসিকভাবে বিশ্বের সব দেশের মানুষের একটি মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত। বাংলাদেশের সংবিধানে দেশের সকল নাগরিকের নিরাপদ ও বসবাসযোগ্য বাসস্থানের অঙ্গিকার ব্যক্ত করা হয়েছে। বাংলাদেশ সংবিধান রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে বাসস্থানকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানের ২৬ থেকে ৪৭ (ক) অনুচ্ছেদের মধ্যে বাসস্থানকে মৌলিক অধিকার হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করেছে।
৩। পোশাকের অধিকার

লজ্জা নিবারণের জন্যে মানুষ যা পরিধান করে তাই পোশাক। সহজভাবে বলতে গেল লজ্জাস্থান ঢাকার জন্য আমরা যে আবরণ ব্যবহার করি তাই পোশাক। মানুষের সৌন্দর্য, রুচিবোধ ও ব্যক্তিত্ব যার মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি প্রকাশ পায় তাই হলো পোশাক। পোশাক ব্যক্তি, সমাজ, সংস্কৃতি, জাতি, ধর্ম, দেশ বিশেষে আলাদা আলাদা হয়ে থাকে এবং আলাদা মূল্যবোধ প্রকাশ করে। বাংলাদেশের সংবিধানের ২৬ থেকে ৪৭ (ক) অনুচ্ছেদের মধ্যে পোশাকের অধিকারকে মৌলিক অধিকার হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করেছে। এই আইন দ্বারা প্রতিটি নাগরিক পোশাকের অধিকার ভোগ করবে এবং তাতে কেউ বাঁধা দেওয়া তো দূরের কথা চাহিদা অনুযায়ী রাষ্ট্র ব্যবস্থা করতে বাধ্য। তবে সংবিধান কারো উপর পোশাকের বাধ্যবাধকতা চাপিয়ে দেয়নি বরং দিয়েছে পছন্দ অনুযায়ী পোশাকের স্বাধীনতা।
৪। শিক্ষা

শিক্ষা বলতে বুঝায় বিশেষ জ্ঞান, কৌশল ও দক্ষতা অর্জন। শিক্ষা হচ্ছে শারীরিক, মানসিক ও আত্মিক শক্তির সম্মিলিত উন্নয়ন। দৈহিক উন্নতি ও মানসিক শান্তির জন্যেও শিক্ষার প্রয়োজন। শিক্ষার্জন প্রত্যেক নাগরিকের অধিকার ও কর্তব্য। শিক্ষা একটি মৌলিক মানবাধিকার। শিক্ষার্থীর মাঝে সুপ্ত সব ধরনের সম্ভাবনা বা মেধার বিকাশ ঘটানোর মাধ্যমে সমাজের চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ ও প্রতিভাবান জনগোষ্ঠী গড়ে তোলা। মানবসভ্যতা ও সমাজ বা রাষ্ট্রের উন্নয়নের চাবকাঠিও শিক্ষা। একটি দক্ষ, সময়উপযোগী ও জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনের জন্য শিক্ষার কেন বিকল্প নেই। বাংলাদেশের সংবিধানের ২৬ থেকে ৪৭ (ক) অনুচ্ছেদের মধ্যে শিক্ষার অধিকারকে মৌলিক অধিকার হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্রের ২৬তম পরিচ্ছেদ অনুযায়ী সমস্ত মানুষের শিক্ষার অধিকার আছে। এই শিক্ষা (ন্যূনতমপক্ষে প্রাথমিক স্তরে) বিনামূল্যের হবে। প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক হবে। রাষ্ট্র নাগরিকদের জন্য চাহিদা অনুযায়ী সকলের জন্য শিক্ষার পরিবেশ ও সুযোগ সুবিধা তৈরিতে বদ্ধপরিকর।
৫। চিকিৎসা

সুস্থ দেহ সুন্দর মন শিক্ষার জন্য প্রয়োজন। সবকিছুর পূর্বে সুস্থ্য থাকা জরুরী। সুস্থ্য মানুষ সুন্দর ও সকল সম্ভাবনাময় ও সুস্থ্য চিন্তা করতে পারে। আমরাই বলে থাকি অসুস্থ্য মানুষের চিন্তা অসুস্থ্য হয়ে থাকে। চিকিৎসা মানুষের একটি মৌলিক অধিকার। রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিক চাহিদা অনুযায়ী মানসম্মত চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার রাখে যা প্রদান করতে রাষ্ট্র বদ্ধপরিকর। সরকারি চিকিৎসাসেবা সাধারণ মানুষের জন্য নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রয়োজনীয় হাসপাতাল, চিকিৎসা সংক্রান্ত যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম নিশ্চিত করে চিকিৎসাসেবা সবার জন্য সহজতর করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া রাষ্ট্রের দায়িত্ব।।বাংলাদেশের সংবিধানের ২৬ থেকে ৪৭ (ক) অনুচ্ছেদের মধ্যে চিকিৎসার অধিকারকে মৌলিক অধিকার হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্রের ২৫ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রত্যেক নাগরিকের পর্যাপ্ত জীবনযাত্রার মানের অধিকার রয়েছে যা, তার নিজের ও নিজের পরিবারের স্বাস্থ্য ও ভাল থাকার জন্য যথেষ্ট। রাষ্ট্র নাগরিকদের জন্য চাহিদা অনুযায়ী সকলের জন্য চিকিৎসার পরিবেশ ও সুযোগ সুবিধা তৈরিতে বদ্ধপরিকর।
৬। নিরাপত্তা

মানুষ সামাজিক জীব। একা বসবাসাস করতে পারে না। যেমন প্রয়োজন খাদ্য, বস্ত্র ও চিকিৎসা তেমনি তারচেয়েও জরুরী ব্যক্তির নিরাপত্তা। নিরাপত্তাহীনতা ব্যক্তির অন্যসকল অধিকারকে হুমকিতে ফেলে। তাই নিরাপত্তার অধিকার মানুষের মৌলিক অধিকার। মানুষের জানমালের নিরাপত্তা ও সুস্থভাবে বেঁচে থাকার অধিকার রাষ্ট্র কর্তৃক সংরক্ষিত এবং নাগরিকের মৌলিক মানবাধিকারের রক্ষাকবচ। সকল মানুষকে নিরাপদ রাখা ও ভয়ডরহীনভাবে বাঁচতে দেওয়া রাষ্ট্রের দায়িত্ব ও কর্তব্য। রাষ্ট্র তার নাগরিকদের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সর্বদা বাধ্য থাকবে। জাতিসংঘের নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক চুক্তি (১৯৬৬) ব্যক্তির নিরাপত্তা অধিকারকেও স্বীকৃতি দেয়। এর ৩নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে “প্রত্যেকেরই স্বাধীনতা এবং ব্যক্তির সুরক্ষার অধিকার রয়েছে” এবং এই অনুচ্ছেদটি “নির্বিচারে গ্রেপ্তার বা আটকে রাখা” নিষিদ্ধ করেছে। বাংলাদেশের সংবিধানের ২৬ থেকে ৪৭ (ক) অনুচ্ছেদের মধ্যে নিরাপত্তার অধিকারকে মৌলিক অধিকার হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে।
বহুল জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন ও উত্তর সমূহ
মানুষের মৌলিক অধিকার ৬টি কি কি এই বিষয়ে আপনার মনে বেশ কয়েকটি প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে? তবে চলুন জেনে নেই সেই সকল সমস্ত সকল প্রশ্ন ও উত্তর।
আমাদের মৌলিক অধিকার নষ্ট হলে বা না পেলে করণীয় কি ?
যে কোনো কারণে মানুষের মৌলিক অধিকার খর্ব হতে পারে। এ ক্ষেত্রে ভুক্তভোগী ব্যক্তি সংবিধানের ১০২ (১) নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে রিট আবেদনের মাধ্যমে অধিকার পুনরুদ্ধার করতে পারবেন।
মৌলিক অধিকার ক্ষুন্ন হলে কি আমি আইনি ব্যবস্থ্যা নিতে পারবো?
এই ৬টি মৌলিক অধিকারকে স্থান দেয়া হয়েছে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে যা আদালতের মাধ্যমে বলবৎযোগ্য নয়। নাগরিকের যদি অন্ন-বস্ত্রের অভাব থাকে, অথবা কেউ যদি শিক্ষার অধিকার ভোগ করতে না পারে অথবা কেউ যদি চিকিৎসার অধিকার না পায় তাহলে সরকারের বিরুদ্ধে কোন মামলা করা যাবে না অথবা মামলা করলেও আদালত উহা বলবৎ করতে পারবে না বা বাধ্য নয়।
উপসংহার
মানবাধিকারই মৌলিক অধিকার যেগুলো কোন দেশের সংবিধানে লিপিবদ্ধ করা হয়। মানুষের মৌলিক অধিকার অর্জন অতিব জরুরী। মৌলিক চাহিদার পর মানুষ অন্য চিন্তা বা কাজে মনোনিবেশন করতে পারে। এজন্য আমাদের প্রতিটি মানুষের মৌলিক অধিকার ৬টি কি কি সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে। সকল মৌলিক অধিকারই মানবাধিকার কিন্তু সকল মানবাধিকার মৌলিক অধিকার নয়। এছাড়াও আপনার জ্ঞানকে প্রসারিত করতে বাংলাদেশ সম্পর্কে ৫টি বাক্য সম্পর্কে পড়তে পারেন।
“মানুষের মৌলিক অধিকার ৬টি কি কি” এই বিষয়ে আপনার যদি কিছু জানার থাকে তবে আপনি এই পোস্টের নিচে মন্তব্য করতে পারেন। এছাড়াও এই পোস্ট-টি তথ্যবহুল মনে হলে আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করতে পারেন। ধন্যবাদ।