পাট কোন মাটিতে ভালো হয় পাট চাষের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। পাট মূলত একটি বর্ষাকালীন ফসল। বাংলাদেশে পাটকে সোনালী আঁঁশ বলে ডাকা হয়। পাট আঁঁশ প্রধানত দুটি প্রজাতির যেমন সাদাপাট ও তোষাপাট নামক হয়ে থাকে। পাট, গোল্ডেন ফাইবার হিসাবে পরিচিত। বহু শতাব্দী ধরে বিভিন্ন শিল্পের প্রধান উপাদান হিসাবে পাটের ব্যবহার হয়ে আসছে। টেক্সটাইল থেকে শুরু করে প্যাকেজিং উপকরণ পর্যন্ত এই বহুমুখী ফসল বিশ্বজুড়ে সুনাম অর্জন করেছে। সফল পাট চাষে অবদান রাখার একটি মূল বিষয় হল সঠিক মাটি বাছাই করা। পাললিক বেলে দোআঁশ, এঁটেল, দোআঁশ মাটি পাট উৎপাদনের জন্য সবচেয়ে বেশি উপযুক্ত।
পাট ভারতে উৎপাদিত প্রাকৃতিক আঁশ ফসলের মধ্যে একটি। ভারতে পাটের চাষ মূলত দেশের পূর্বাঞ্চলেই বেশি হয়ে থাকে। আসাম, উড়িষ্যা, বিহার,পশ্চিমবঙ্গ,উত্তর প্রদেশ, ত্রিপুরা এবং মেঘালয়সহ ভারতের সাতটি রাজ্যের প্রায় ৮৩ টি জেলায় পাট ফসল উৎপন্ন হয়। পাট তন্তু জাতীয় উদ্ভিদ। পাটগাছের ছাল থেকে পাটের আঁশ সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। পাটের আঁশের রঙ সোনালি এবং বাংলাদেশের রফতানি আয়ের ২৫ শতাংশ আসে এই পাট থেকে। বিশ্বের মোট প্রায় ১৯ লাখ হেক্টর জতিতে পাট চাষ করা হয় এবং ৩২ লাখ মেট্রিক টন পাট উৎপাদন হয়। প্রতি হেক্টর জমিতে পাট উৎপাদন হয় ১ হাজার ৬৫৬ কেজি। পাট উৎপাদনে বিশ্বে এশিয়া মহাদেশই প্রথম কারন বিশ্বের ৯৫ শতাংশ পাট এশিয়ায় জন্মে।
পাট কি?
পাট এর বৈজ্ঞানিক নাম: corchorus spp। এটি একটি বর্ষাকালীন ফসল। এর জীবনকাল ১০০ থেকে ১২০ দিন পর্যন্ত হয়ে থাকে। বাংলাদেশে পাটকে সোনালী আঁশ বলা হয়ে থাকে এবং পাটই বাংলার শত বর্ষের ঐতিহ্য। পাটের আঁশ হল এক ধরনের উদ্ভিদ আঁশ। পাট গাছের বাকল থেকে এবং অল্প পরিমাণে টোসা পাট থেকে আহরণ করা হয়। এটি সোনালী এবং সিল্কি চকচকে একটি প্রাকৃতিক ফাইবার এবং তাই একে গোল্ডেন ফাইবার বলা হয়। পাট একটি বার্ষিক ফসল যা এপ্রিল/মে-জুলাই/আগস্ট মাসে কাটা হয়।
বেলে মাটি কি?
সাধারনত যে মাটিতে ৭০ ভাগ বা তার বেশি পরিমান বালিকণা থাকে তাকে বেলে মাটি বলে। মরুভূমি, চরাঞ্চল ও সমুদ্র উপকূলে বেলে মাটির পরিমান বেশি দেখা যায়। এই মাটির পানি ধারণক্ষমতা খুবই কম। এই মাটিতে জৈব পদার্থ নেই বললেই চলে। তাই এ মাটি যে কোন ফসল চাষের উপযোগী নয়।
দো-আঁশ মাটি কি?
যে মাটিতে বালি, পলি এবং কর্মকণা প্রায় সমান অনুপাতে বিদ্যমান থাকে তাকে দো-আঁশ মাটি বলে। এ মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ অনেক বেশি থাকে। তাই চাষের জন্য সর্বাপেক্ষা উপযোগী হচ্ছে এই মাটি। এ মাটির পানি ধারণ ও শোষণক্ষমতা উভয়ই অনেক বেশি। বাংলাদেশের স্থলভাগের বেশিরভাগ মাটি দো-আঁশ মাটি। কৃষিক্ষেত্রে দো-আঁশ মাটিকে আদর্শ মাটি বলা হয়ে থাকে।
পাট কোন মাটিতে ভালো হয়?
বাংলাদেশের জলবায়ু ও মাটি পাট চাষের জন্য খুবই উপযোগী। পৃথিবীর মধ্যে বাংলাদেশে সবচেয়ে ভালো পাট জন্মে থাকে যার সুনাম সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের মধ্যে ফরিদপুর, পাবনা, কুষ্টিয়া, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ, যশোর ও নওগাঁ জেলায় পাটের উৎপাদন বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশ ছাড়াও থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, মিসর, ভারত ও আমেরিকায় পাটের চাষ হয়।পাট চাষের জন্য উষ্ণ জলবায়ু ও প্রচুর বৃষ্টিপাতের প্রয়োজন হয়। ফাল্গুন ও চৈত্র মাস পাট বপনের জন্য উপযুক্ত সময়। শ্রাবণ ও ভাদ্র মাসে পাটগাছ কেটে ছোট ছোট আঁটি বাঁধা হয়। আর এখান থেকে সংগ্রীত সেই আঁশকে পাট বলা হয়। পাটের ভেতরের কাঠিকে পাটকাঠি বলে থাকে। নিচে পাট কোন মাটিতে ভালো হয় সেই মাটির বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনার করা হলো।
- বাংলাদেশে নদীমাতৃক দেশ। এদেশের যমুনা, মেঘনা, ব্রহ্মপুত্র প্রভৃতি নদ-নদীর পলিবাহিত উর্বর সমতল ভূমিতে পাট ভালো জন্মে।
- বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নদীবাহিত গভীর পলিমাটি পাট চাষের জন্য বিশেষ উপযোগী।
- মূলত দোআঁশ ও বেলে দোআঁশ মাটিতেই পাট ভালো জন্মে। বেলে দোআঁশ এবং এটেল দোআঁশ মাটি তাদের চমৎকার নিষ্কাশন বৈশিষ্ট্যের কারণে পাট চাষের জন্য আদর্শ মাটি বলে বিবেচিত হয়। যদিও বেলে দোআঁশ এবং এটেল দোআঁশ মাটিতে পাট ভালো হয় কিন্তু একটি সুষম জমি যাতে কিছু পলি ও কাদামাটি থাকে তা পাট চাষের জন্য উপকারী হয়। পলি এবং কাদামাটি আর্দ্রতা এবং পুষ্টি ধরে রাখতে সাহায্য করে যার কারনে সুস্থ উদ্ভিদের বৃদ্ধির প্র্রসার ঘটে।
- যেখানে বৃষ্টিপাতের পরিমান বেশি সেখানে পাট ভালো জন্মে। মার্চ, এপ্রিল ও মে পর্যন্ত প্রতি মাসে সর্বনিম্ন ২৫০ মিমি বৃষ্টিপাতসহ যেখানে বার্ষিক বৃষ্টিপাত ১৫০০ মিমি বা ততোধিক হয়ে থাকে। তাই বাংলাদেশে পাট চাষের জন্য উপযুক্ত ভূমি।
- সাধারনত সাদাপাট নিচুজমি এমনকি জলাবদ্ধ জমিতেও চাষ করা যায়।
- তবে জলবদ্ধতা তোষাপাটের জন্য ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়ায়।জলাবদ্ধতার কারণে শিকড় পঁচে যেতে পারে এবং পাটের বৃদ্ধিতে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।
- পাট গাছ ভালোভাবে পানি নিষ্কাশন করা মাটি পছন্দ করে। কারন যা অতিরিক্ত পানি সহজেই বের করে দিতে পারে এবং পাট ভালো হয়।
- সাধারনত পাট গাছগুলি সামান্য অম্লীয় থেকে নিরপেক্ষ pH পরিসীমা সহ মাটিতে বৃদ্ধি পেয়ে থাকে। সাধারণত 6.0 থেকে 7.0 এর মধ্যে হয়ে থাকে। এই পিএইচ স্তর মাটিতে প্রয়োজনীয় পুষ্টির প্রাপ্যতাকে সমর্থন করে পাটের বৃদ্ধির জন্য সর্বোত্তম অবস্থা নিশ্চিত করে।
- পাট চাষের জন্য মাটিতে জৈব পদার্থ থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। ভালোভাবে পঁচনশীল জৈব উপাদান যেমন কম্পোস্ট বা খামারের সার মাটির উর্বরতা বাড়ায়। তাই পাট গাছের শক্তিশালী বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি সরবরাহ করে এমন মাটি পাট চাষের জন্য উপযোগী।
- ২৫ থেকে ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার মধ্যে উষ্ণ জলবায়ুর জন্য পাট গাছগুলি উপযুক্ত । তাই যে স্থানে এই আদর্শ তাপমাত্রা বিরাজ করে সেই মাটি পাট চাষের জন্য উপযুক্ত। যদিও পাট বিভিন্ন ধরনের তাপমাত্রা সহ্য করতে পারে কিন্তু এটি প্রচুর সূর্যালোকিত অঞ্চলে বেশি বৃদ্ধি পায় এবং ফাইবার বিকাশের সুযোগ পায়।
- সাধারনত দোআঁশ মাটিতে বালি, পলি ও কাদা সম পরিমানে থাকে। এ মাটির পানি ধারন ক্ষমতামাঝারী। তাই পাট চাষাবাদের জন্য দোআঁশ মাটিই উপযুক্ত।
বহুল জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন ও উত্তর সমূহ
পাট কোন মাটিতে ভালো হয় এই বিষয়ে আপনাদের মনে বেশ কিছু পশ্ন থাকতে পারে। তবে চলুন জেনে নেওয়া যাক সেই সমস্ত সকল প্রশ্ন ও তার উত্তর।
পাটকে সোনালী আঁশ বলা হয় কেন?
পাটকে সোনালী আঁশ বলা হয়। এর আঁশ দেখতে সোনালী রং এর মত দেখায় আবর সেই আঁশ বিক্রি করে প্রচুর অর্থ আয় করা যায় তাই পাটকে সোনালী আঁ নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে। পাট ও পাটজাত দ্রব্য রপ্তানির মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রতিবছর প্রচুর পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে। মূলত এই কারনেই বাংলাদেশে পাটকে ‘সোনালী আঁশ’ বলা হয়।
পাটকে অর্থকরি ফসল বলা হয় কেন?
একসময় বাংলাদেশে প্রচুর পরিমানে পাট চাষ হতো। বাংলাদেশের প্রায় ৮০ ভাগ কৃষক এই পাট চাষের সাথে জড়িত ছিল। সেই উৎপাদিত পাট দেশীয় চাহিদা পূরন কের বিদেশে রপ্তানি করা হতো। বাংলাদেশের পাটের গুনগত মানের কারনে সারাবিশ্বে এর গ্রহনযোগ্যতা ছিল বেশ। যার ফলে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা যেত। তাই পাটকে অর্থকরি ফসল বলা হয়ে থাকে।
উপসংহার
পাট বাংলাদেশের একটি প্রধান অর্থকরী ফসল। দেশে উৎপাদিত পাটের শতকরা প্রায় ৭০ ভাগ দেশে ব্যবহার করা হয় আর বাকি ৩০ ভাগ কাঁচা পাট ও পাটজাত দ্রব্য হিসেবে রপ্তানি করা হয়ে থাকে। সাধারনত পাটের আঁশ থেকে বস্তা, পর্দা, কার্পেট, পাটের সুতা, ব্যাগ, ইত্যাদি তৈরি করা হচ্ছে। পাটকাঠি থেকে পার্টিকেল বোর্ড, প্রিন্টারের কালিও বর্তমানে তৈরি করা হচ্ছে। সর্বশেষ পাট থেকে উৎপাদিত পলিথিনের বিকল্প পচনশীল ব্যাগ বাংলাদেশসহ গোটা বিশ্বে সাড়া ফেলে দিয়েছে। এক হেক্টর বা সাড়ে সাত বিঘা জমিতে পাট চাষ করলে তা মোট তিন মাসের ১৫ টন কার্বন ডাইঅক্সাইড শোষণ করে নেয় এবং ১১ টন অক্সিজেন প্রকৃতিকে দেয় যা জীবের জন্য খুবই প্রয়োজনীয়।
পাট চাষের সাফল্য নির্ভর করে মূলত পাট কোন মাটিতে ভালো হয় সেই সঠিক মাটি নির্বাচন করার উপর। বেলে দোআঁশ এবং এটেল দোআঁশ মাটি ভাল নিষ্কাশন এবং সামান্য অম্লীয় থেকে পর্যাপ্ত জৈব পদার্থ বিদ্যমান থাকে। তাই প্রতিটি পাট চাষীর অবশ্যই চাষের পূবে জেনে নিতে হবে পাট কোন মাটিতে ভালো হয় । এছাড়াও আপনার জ্ঞানকে প্রসারিত করতে জিংক সমৃদ্ধ ধানের জাতের নাম সম্পর্কে পড়তে পারেন।
“পাট কোন মাটিতে ভালো হয়” এই বিষয়ে আপনার যদি কিছু জানার থাকে তবে আপনি এই পোস্টের নিচে মন্তব্য করতে পারেন। এছাড়াও এই পোস্ট-টি তথ্যবহুল মনে হলে আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করতে পারেন। ধন্যবাদ।