শিশুর ডেঙ্গু রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান রাখা আমাদের সকলের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি বিষয়। কেননা, আজকের শিশুই কিন্তু আগামীর ভবিষ্যৎ। সুতরাং, আমাদের কিছু ভুলের কারণে শিশু মারাত্মক ব্যধি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে যেন অকালে প্রাণ না হারায় সেদিকে আমাদের বিশেষভাবে নজর দেওয়া উচিত। আজকের আলোচনায় আমরা শিশুর ডেঙ্গু হওয়ার কারণ, লক্ষণ আর তার প্রতিকার সর্ম্পকে আলোকপাত করতে চলেছি। প্রিয় পাঠক, সাথেই থাকুন আর ডেঙ্গু সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন। চলুন তবে শুরুতেই জেনে নিই, ডেঙ্গু আসলে কি?
ডেঙ্গু কি?

ডেঙ্গু একটি ভাইরাসজনিত রোগ যা এডিস মশার কামড়ের মাধ্যমে ছড়িয়ে থাকে। এডিস মশার কামড়ানোর পর সংক্রমণ দেখা দিতে সাধারণত ৩-১৫ দিন পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। রোগের লক্ষণ বুঝে উঠার ঠিক পরই সঠিক চিকিৎসা না করা হলে ডেঙ্গু এক সময় মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। অনেক সময় এটি অনেক বেশি ক্ষতিকর রূপ নিতে পারে যাকে সাধারণত ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার বলা হয়ে থাকে। কয়েক প্রজাতির এডিস মশা যাদের মধ্যে এডিস ইজিপ্টি অন্যতম; এই ভাইরাস সংক্রমণের জন্য বিশেষভাবে দায়ী। ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি ধরন রয়েছে, সেগুলো হচ্ছে, ডেন-১, ডেন-২, ডেন-৩ এবং ডেন-৪।
ডেঙ্গু রোগের কারণ

শিশুর ডেঙ্গু রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান অর্জনের জন্য আমাদেরকে ডেঙ্গু রোগের কারণ সম্পর্কে অবশ্যই সঠিক তথ্য জেনে নিতে হবে। এ পর্যায়ে আমরা ডেঙ্গু রোগের কারণ নিয়ে আলোচনা করবো। ডেঙ্গু রোগের কারণ হচ্ছে ডেঙ্গু বহনকারী এডিস মশা। কেননা, এই মশার মাধ্যমেই এই মারাত্মক ব্যধির দেখা ঘটে। বিশেষ করে আমাদের দেশে যখন প্রচুর বৃষ্টিপাত হয় ঠিক তখনই এই মশা বংশ বিস্তার করে থাকে। ডেঙ্গু কিন্তু অন্যান্য ভাইরাসের মতই এক ধরণের ভাইরাস। সুতরাং বুঝতেই পারছেন ডেঙ্গু রোগের আসল কারন কি? চলুন এবার আমরা এই রোগের লক্ষণ সম্পর্কে জেনে আসি।
শিশুর ডেঙ্গু রোগের লক্ষণ

শিশুর ডেঙ্গু রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার সম্পর্কে আলোচনা করার শুরুতে আমরা ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণগুলো সম্পর্কে জানবো। ডেঙ্গু জ্বরের অনেগুলো লক্ষণ রয়েছে। এগুলোর মধ্যে সাধারণ উপসর্গগুলো নিচে তুলে ধরা হলো-
- উচ্চ জ্বর (104°F বা 40°C এর বেশি)
- মাথাব্যথা
- চোখের পিছনে ব্যথা
- পেশী ও গাঁটে ব্যথা
- বমি বা বমি বমি ভাব
- গাত্রচর্মে ফুসকুড়ি
- ডায়রিয়া হওয়া
- অনেক সময় রক্তপাতও হয়ে থাকে।
শিশু বাচ্চার ক্ষেত্রে সাধারণত আগে জ্বর আসে এবং ক্রমেই শিশুর শরীর দুর্বল হয়ে যায়। শরীর, হাত ও পা ব্যাথা করতে পারে যদিও অনেক শিশু বলতে পারে না, তাদের হাত-পা এর গতিবিধি থেকে বুঝতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে, ডেঙ্গু দেখা দিলে সাধারণত শুরুতে জ্বর আসে না, আর জ্বর আসার পর কিছুতেই নামতে চায় না।
ডেঙ্গু জ্বরের একটি মারাত্মক রূপ হল ডেঙ্গু শক সিনড্রোম (DSS), যা রক্তচাপ হ্রাস, শ্বাসকষ্ট এবং শরীরের বিভিন্ন অংশে রক্তপাতের কারণ হতে পারে। DSS একটি জরুরি অবস্থা, এবং চিকিৎসা না পেলে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। আমরা সকলেই জানি যে, শিশুদের ধারণ ক্ষমতা আমাদের বড়দের তুলনায় অনেক কম। সুতরাং, কোন শিশুর মাঝে এমন লক্ষণ প্রকাশ পেলে কালক্ষেপন না করে যতটা দ্রুত সম্ভব বিশেষজ্ঞ শিশু ডাক্তারের সরণাপন্ন হওয়া উচিত।
ডেঙ্গু রোগের প্রতিকার ও প্রতিরোধ

ডেঙ্গু রোগের চিকিৎসা আসলে কি তারই বিস্তারিত তথ্য নিয়ে আমরা এখন আলোচনা করবো। সত্যিকার অর্থে, ডেঙ্গু রোগের প্রতিকারের জন্য নির্দিষ্ট কোনো ওষুধ বা ভ্যাকসিন নেই। তবে, ডেঙ্গু রোগের লক্ষণগুলোর জন্য আমরা চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পারি। ডেঙ্গু জ্বরের চিকিৎসার জন্য নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলি নেওয়া যেতে পারে-
- জ্বর কমানোর জন্য প্যারাসিটামল বা আইবুপ্রোফেন ব্যবহার করা যেতে পারে।
- ব্যথার জন্য ব্যথানাশক ব্যবহার করা যেতে পারে।
- তরল খাবার এবং স্যালাইন পান করা জরুরি, যাতে শরীরে পানিশূন্যতা না হয় অথবা এই ঘাটতি পূরণ হয়ে যায়।
- ডেঙ্গু জ্বরের গুরুতর রূপের ক্ষেত্রে, রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করা এবং রক্তদান প্রয়োজন হতে পারে। ডেঙ্গু জ্বর মারাত্মক আকার নেওয়ার পূর্বেই সঠিক পদক্ষেপ নিন।
ডেঙ্গু জ্বরের সংক্রমণ প্রতিরোধের জন্য নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলি নেওয়া যেতে পারে-
- এডিস মশার প্রজননস্থল ধ্বংস করা। যত্রতত্র পানি ফেলা থেকে বিরত থাকতে হবে। বাসায় ফুলে টব, ছোট কোন গর্তে যাতে বেশ কয়েকদিন যাবৎ পানি না জমে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। ফুলের টবের পানি কয়েকদিন পরপর পরিবর্তন করে ফেলা উচিত।
- মশা প্রতিরোধক ব্যবহার করা।
- মশার কামড় থেকে নিজেকে রক্ষা করা। এডিস মশা সাধারণত দিনের বেলায় কামড় দেয়। তাই দিনে ঘুমানোর পূর্বে লম্বা হাতা জামা পড়ুন আর সেই সাথে প্রয়োজনে মশারি টানিয়ে ঘুমান।
এডিস মশা সাধারণত জমে থাকা পানিতে বংশ বিস্তার করে থাকে। এই মশার ডিমসহ লার্ভা আর পিউপা কয়েকদিন ধরে জমে থাকা পানিতে পাওয়া যায়। আমরা এডিস মশার প্রজননস্থল ধ্বংস করার জন্য নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো নিতে পারি-
- ফুলের টব, ড্রাম, বালতি বা অন্যান্য পাত্রে জল জমা করা এড়িয়ে চলা।
- এয়ার কন্ডিশনার, ফ্যান বা অন্যান্য ডিভাইসের ড্রেইন পয়েন্টগুলি পরিষ্কার রাখা।
- জলাশয় এবং অন্যান্য জলাশয়গুলিতে মশা প্রতিরোধক ঔষধ ছড়িয়ে দেওয়া।
মশা প্রতিরোধক ব্যবহার করা ডেঙ্গু জ্বরের সংক্রমণ প্রতিরোধের একটি কার্যকর উপায়। মশার কামড় থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলি নেওয়া যেতে পারে-
- পোশাক পরুন যা ত্বককে ঢেকে রাখে।
- ঘরে থাকাকালীন মশার জাল গ্রামীন ভাষায় যাকে মশারি বলা হয় এটা ব্যবহার করুন।
- এছাড়াও আপনি মশার কয়েল বা ল্যাম্প ব্যবহার করতে পারেন।
রোগের লক্ষন দেখার পর সঠিক চিকিৎসা না করানো হলে শিশু বাচ্চার ক্ষেত্রে ডেঙ্গু গুরুতর আকার ধারণ করতে পারে, তবে সঠিক প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে এবং উপসর্গগুলি সনাক্ত করে আর সেই সাথে চিকিৎসা করে এটি প্রতিরোধ বা নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে।
বহুল জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন-উত্তর সমূহ
ডেঙ্গু রোগ সম্পর্কিত অনেক কিছু তো এতক্ষণ জানলাম। শিশুর ডেঙ্গু রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার এ সম্পর্কে জানার পরও নিশ্চয় আরও কিছু প্রশ্ন হয়তো আপনার মনে উঁকি দিচ্ছে। আসুন জেনে নেওয়া যাক সেই সকল প্রশ্ন এবং উত্তরসমূহ-
শিশুর ডেঙ্গু রোগের ক্ষেত্রে কোন কোন পরিস্থিতিতে জরুরি চিকিৎসার প্রয়োজন হতে পারে?

শিশুর ডেঙ্গু রোগের ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত পরিস্থিতিতে জরুরি চিকিৎসার প্রয়োজন হতে পারে-
- জ্বর ৪০°C (১০৪°F) এর বেশি হলে।
- অনেক সময় জ্বর দীর্ঘ সময় থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে, জ্বর ৪৮ ঘণ্টার বেশি স্থায়ী হলে।
- ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত শিশুর জ্বরের সাথে বমি হতে পারে। এমন পরিস্থিতি-তে জরুরী চিকিৎসার প্রয়োজন।
- জ্বরের সাথে ফুসকুড়ি দেখা দিলে।
- জ্বরের সাথে পানিশূন্যতার লক্ষণ দেখা দিলে, যেমন কম প্রস্রাব, ঠোঁট শুষ্ক হয়ে যাওয়া, বা চোখ ঢুপঢুপ করা।
ডেঙ্গু জ্বরে কখন এবং কী ধরণের টেস্ট করাতে হয়?

ডেঙ্গু রোগের লক্ষণ প্রকাশ পেলে দ্রুতই চিকিৎসা করানো উচিত। ডেঙ্গু হলে খুব বেশি টেস্টের প্রয়োজন পড়ে না। এই জ্বরে আক্রান্ত ব্যক্তির জন্য সাধারণত ডেঙ্গু এনএস১ এন্টিজেন নামক টেস্ট, অ্যান্টিবডি পরীক্ষা করাসহ সিবিসি (প্লাটিলেট কাউন্টসহ) পরীক্ষা করানোই যথেষ্ট।
উপসংহার
প্রিয় পাঠক, ‘শিশুর ডেঙ্গু রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার‘ নিয়ে তুলে ধরা আমাদের তথ্যগুলো আপনাদের কেমন লেগেছে তা কিন্তু কমেন্ট করে জানাবেন। এ সম্পর্কিত কোন তথ্যের বিশষে আপনার কিছু জানা থাকলে কিংবা কোন তথ্যের বিষয়ে সন্দেহ থাকলে তা কমেন্টে জানাতে ভুলবেন না কিন্তু। এছাড়াও আপনার জ্ঞানকে প্রসারিত করতে কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবার তালিকা এ সম্পর্কে পড়তে পারেন।
আপনাদের সকলের জীবন সুখ ও সমৃদ্ধিতে ভরে উঠুক, ডেঙ্গুর মারাত্মক ক্ষতি থেকে সুরক্ষিত থাকুন এই প্রত্যাশায় আজকের মত বিদায় নিচ্ছি। আল্লাহ্ হাফেজ।