নেত্রকোনা কিসের জন্য বিখ্যাত তার বিস্তারিত তথ্য থাকছে আজকের আলোচনায়। প্রিয় পাঠক, ময়মনসিংহ বিভাগের অন্যতম জেলা নেত্রকোনা বিখ্যাত হওয়ার পেছনে এর ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি, বিখ্যাত খাবার, দর্শনীয় স্থান বিশেষ ভূমিকা পালন করে। আমরা আজকে নেত্রকোনা জেলার বিখ্যাত হওয়ার অন্যতম কারণসমূহ খতিয়ে দেখবো। সাথে থাকবেন তো! তাহলে চলুন শুরু করা যাক-
নেত্রকোনা কিসের জন্য বিখ্যাত
উপজেলার সংখ্যা হিসেব করলে নেত্রকোনাকে ‘এ’ শ্রেণীভূক্ত জেলা হিসেবে ধরা হয়। এই জেলায় রয়েছে শত শত দর্শনীয় স্থান যা লক্ষ লক্ষ মানুষের হৃদয়ে আনন্দ সরবরাহ করে থাকে। এই জেলার আয়তন ২,৮১০ বর্গ কিলোমিটার। সত্যিকার অর্থে কোন জেলা বিখ্যাত হওয়ার জন্য বেশ কিছু কারণ থাকে। নেত্রকোনা কিসের জন্য বিখ্যাত আজকে তাই পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে জানবো ইনশাআল্লাহ্।
নেত্রকোনা জেলা সম্পর্কে কিছু তথ্য
নেত্রকোনা বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের একটি জেলা। এটি ময়মনসিংহ বিভাগের আটটি জেলার একটি। নেত্রকোনার উত্তরে সুনামগঞ্জ জেলা, পূর্বে ভারতের মেঘালয় রাজ্য, দক্ষিণে কিশোরগঞ্জ ও ময়মনসিংহ জেলা এবং পশ্চিমে ব্রাহ্মপুত্র নদ ও জামালপুর জেলা অবস্থিত। নেত্রকোনা জেলার আয়তন ২,৮১০ বর্গ কিলোমিটার। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, নেত্রকোনার জনসংখ্যা ২২,২৯,৪৬৪ জন। এর মধ্যে পুরুষ ১১,১১,৩০৬ জন এবং মহিলা ১১,১৮,৩৩৬ জন। নেত্রকোনা জেলার প্রধান নদীসমূহ হল ব্রহ্মপুত্র, সুরমা, ও হাওড়া। জেলার উল্লেখযোগ্য নদীগুলো হল হাওড়া, মরা হাওড়া, গঙ্গা, ঝিঝা, চিত্রা, কালীগঙ্গা, সোমেশ্বরী, ভেড়ামারা, ও গড়িয়াখালী। নেত্রকোনা জেলার প্রধান অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড হল কৃষি, ব্যবসা-বাণিজ্য, ও শিল্প। জেলার প্রধান ফসল হল ধান, পাট, আলু, ও ভুট্টা। জেলায় আম, কাঁঠাল, লিচু, ও পেয়ারাসহ বিভিন্ন ধরনের ফলমূল উৎপন্ন হয়। জেলায় ধানের চাষের জন্য বিখ্যাত আটটি হাওড়া রয়েছে। এছাড়াও, জেলায় তিস্তা ব্যারেজ, ময়মনসিংহ-কাপাসিয়া রেলপথ, ও নেত্রকোনা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবস্থিত।
নেত্রকোনার বিখ্যাত খাবার
নেত্রকোণা বাংলাদেশের উত্তরপূর্বাঞ্চলে অবস্থিত একটি জেলা। এই জেলার নিজস্ব কিছু বিখ্যাত খাবার রয়েছে। নেত্রকোনার বিখ্যাত খাবারগুলির মধ্যে রয়েছে:
বালিশ মিষ্টি
নেত্রকোনার সবচেয়ে বিখ্যাত খাবার হল বালিশ মিষ্টি। এটি আকারে বালিশের মত বড় না হলেও দেখতে অনেকটা বালিশের মত, এবং এর উপরে ক্ষীরের প্রলেপ থাকাতে একটি আবরণীসমেত বালিশের মত দেখায়। এই মিষ্টি গয়ানাথের বালিশ নামেও পরিচিত।
আখের রস
নেত্রকোণা জেলা আখের জন্য বিখ্যাত। এখানে উৎপন্ন আখের রস অত্যন্ত সুস্বাদু। নেত্রকোনার আখের রস সারাদেশেই বিখ্যাত।
খিচুড়ি
নেত্রকোনার খিচুড়ি অত্যন্ত সুস্বাদু। এখানে উৎপন্ন চাল ও ডাল দিয়ে তৈরি এই খিচুড়ি খেতে খুবই মজা।
ডাল দিয়ে ইলিশ মাছ
নেত্রকোনা ইলিশ মাছের জন্যও বিখ্যাত। এখানে ইলিশ মাছ দিয়ে ডাল রান্না করা হয়, যা অত্যন্ত সুস্বাদু।
মিষ্টি আলু
নেত্রকোনার মিষ্টি আলু অত্যন্ত সুস্বাদু। এই আলু দিয়ে বিভিন্ন ধরনের খাবার রান্না করা হয়।
কাঁচা মরিচের চাটনি
নেত্রকোনার কাঁচা মরিচের চাটনি অত্যন্ত ঝাল। এই চাটনি মাছ, মাংস, সবজি ইত্যাদির সাথে খাওয়া হয়।
নেত্রকোনার বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গ
ঐতিহ্যবাহী জেলা নেত্রকোনায় বহু বিখ্যাত ব্যক্তি রয়েছেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজনের নাম ও তাদের অবদান আমরা এখানে সংযুক্ত করছি।
- মনসুর বয়াতি – অত্যন্ত জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব মনসুর বয়াতি ছিলেন একাধারে একজন পল্লিকবি ও বিশিষ্ট গায়ক।
- মুহাম্মদ ইব্রাহীম খাঁ – এই উপমহাদেশের স্বজাতি আন্দোলনের একজন বিশিষ্ট মুসলিম নেতা হিসেবে তার নাম অগ্রগণ্য।
- জ্ঞানচন্দ্র মজুমদার – তিনি ছিলেন, ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন অন্যতম ব্যক্তিত্ব ও সেই সাথে অগ্নিযুগের বিপ্লবী ও অনুশীলন সমিতির অন্যতম শীর্ষনায়ক।
- চন্দ্রকুমার দে – একাধারে একজন লেখক ও লোকগল্প, লোকগীতি গবেষক ও সংগ্রাহক।
- মুজীবুর রহমান খাঁ – তিনি হলেন একজন বাংলাদেশী সাংবাদিক ও সাহিত্যিক।
- কুমুদিনী হাজং – কুমুদিনী হাজং ছিলেন টংক আন্দোলনের বিপ্লবী নেত্রী।
- নির্মলেন্দু গুণ – আপনি নিশ্চয় নির্মলেন্দু গুণ এর নাম শুনে থাকবেন। তিনি একজন প্রখ্যাত কবি এবং চিত্রশিল্পী।
- কুন্তল বিশ্বাস – তিনি হচ্ছেন বাংলাদেশের রাজনীতিক, সাংবাদিক ও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সর্বাধিক সমাদৃত ব্যক্তিত্ব।
- হুমায়ুন আহমেদ – এপার বাংলার জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হচ্ছেন হুমায়ুন আহমেদ।
- কুদ্দুস বয়াতি – কুদ্দুস বয়াতির গান শুনেন নাই এমন কাউকে পাওয়া হয়তো দুষ্কর হতে পারে। তিনি একজন জনপ্রিয় গীতিকার ও সুরকার এবং বাউল শিল্পী।
- তারা উদ্দিন – জনপ্রিয় এই ব্যক্তিত্ব বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের একজন বীর বিক্রম খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন।
- মুহম্মদ জাফর ইকবাল – একইসাথে লেখক, পদার্থবিদ ও শিক্ষাবিদ হিসেবে সমাদৃত।
- শ্যামল চৌধুরী – একজন ভাস্কর শিল্পী হিসেবে তার অনেক সুখ্যাতি রয়েছে। রাজু ভাস্কর্যের অন্যতম নকশাকারক হলেন শ্যামল চৌধুরী।
- অখিল পাল – বাংলাদেশের খ্যাতিমান ভাস্কর শিল্পী অখিল পালের নাম শুনেন নাই এমন কেউ আছে বলে আমার মনে হয় না। অত্যন্ত সুক্ষ্ম ভাস্কর তৈরীতে তাঁর জুড়ি মেলা ভার।
- আবদুল হাননান খান – তিনি হচ্ছেন, অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা ও যুদ্ধ অপরাধী মামলার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (বাংলাদেশ) তদন্তকারী এর একজন স্বনামধন্য কর্মকর্তা।
- অসীম কুমার উকিল – একাধারে একজন রাজনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সেই সাথে আটপাড়া নির্বাচনিয় এলাকা – জাতীয় সংসদ সদস্য কেন্দুয়া।
- জয়নুল আবেদিন – বিখ্যাত চিত্র শিল্পী।
- চিত্রা ভট্টাচার্য – অনেক স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব চিত্রা ভট্টাচার্য ছিলেন রাজনীতিবিদ ও প্রাক্তন জাতীয় সংসদ সদস্য মহিলা আসন টাঙ্গাইল।
নেত্রকোনার দর্শনীয় স্থান
নেত্রকোনা বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত একটি জেলা। এই জেলাটি তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, ঐতিহাসিক স্থাপনা, ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের জন্য বিখ্যাত। নেত্রকোনার দর্শনীয় স্থানগুলির মধ্যে রয়েছে:
বিরিশিরি
বিরিশিরি নেত্রকোনার একটি উপজেলা। এটি তার চীনামাটির পাহাড়ের জন্য বিখ্যাত। এই পাহাড়টি প্রায় ৪০০ ফুট উঁচু। পাহাড়ের গায়ে ছোট ছোট হ্রদ রয়েছে।
ডিঙ্গাপোতা হাওর
ডিঙ্গাপোতা হাওর নেত্রকোনার একটি হাওর। এটি দেশের বৃহত্তম হাওরগুলির মধ্যে একটি। হাওরটিতে বিভিন্ন ধরনের মাছ পাওয়া যায়।
কমলা রাণীর দিঘী
কমলা রাণীর দিঘী নেত্রকোনার একটি দিঘী। এটি সুরম্য ও দর্শনীয়। দিঘীর মাঝখানে একটি চমৎকার দ্বীপ রয়েছে।
সাত শহীদের মাজার
সাত শহীদের মাজার নেত্রকোনার একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হওয়া সাতজন মুক্তিযোদ্ধার সমাধি এখানে অবস্থিত।
উপজাতীয় কালচারাল একাডেমী
উপজাতীয় কালচারাল একাডেমী নেত্রকোনার একটি সংস্কৃতি কেন্দ্র। এখানে বিভিন্ন আদিবাসী সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রদর্শনী রয়েছে।
শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব স্মৃতিসৌধ
শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব স্মৃতিসৌধ নেত্রকোনার একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা। রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহধর্মিণী শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের স্মরণে এই স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয় ১৯৮৫ সালের ১৭ মার্চ এ।
টংক শহীদ স্মৃতিসৌধ
টংক শহীদ স্মৃতিসৌধ নেত্রকোনার একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা। ১৯৬৩ সালে টংক দুর্গাপুরে সংঘটিত টংক আন্দোলনের শহীদদের স্মরণে এই স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়েছে।
রানীখং মিশন
রানীখং মিশন নেত্রকোনার একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা। ১৮৯৯ সালে ফাদার লুইস বুলার্ড এই মিশনটি প্রতিষ্ঠা করেন।
পাঁচগাও
পাঁচগাও নেত্রকোনার একটি গ্রাম। এটি তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও ঐতিহ্যের জন্য বিখ্যাত। গ্রামটিতে পাহাড়, নদী, ও জলাভূমি রয়েছে।
এছাড়াও নেত্রকোনার অন্যান্য দর্শনীয় স্থানগুলির মধ্যে রয়েছে: সোমেশ্বরী নদী, হাওড়া, কুমুদিনী স্তম্ভ, চরহাইজদা হাওর, ১২ দুয়ারী ঢিবি, ময়মনসিংহ-কাপাসিয়া রেলপথ, ও নেত্রকোনা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অন্যতম।
বহুল জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন-উত্তর সমূহ
অনেক দর্শনীয় স্থানে ভরপুর জেলা নেত্রকোনার অনেক তথ্য ইতোমধ্যেই পেয়ে গেছেন। সেই সাথে, নেত্রকোনা কিসের জন্য বিখ্যাত তারও একটি বিস্তর ধারণা পেয়েছেন আশা করি। এখন চলুন আরো কিছু জানার চেষ্টা করা যাক-
নেত্রকোনা জেলা কোথায় অবস্থিত?
নেত্রকোনা জেলা বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত। এটি ময়মনসিংহ বিভাগের একটি জেলা।
নেত্রকোনার আয়তন কত?
নেত্রকোনা জেলার আয়তন ২,৮১০ বর্গ কিলোমিটার।
নেত্রকোনার জনসংখ্যা কত?
২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, নেত্রকোনার জনসংখ্যা ২২,২৯,৪৬৪ জন। এর মধ্যে পুরুষ ১১,১১,৩০৬ জন এবং মহিলা ১১,১৮,৩৩৬ জন।
নেত্রকোনার প্রধান নদীসমূহ কী কী?
নেত্রকোনার প্রধান নদীসমূহ হচ্ছে ব্রহ্মপুত্র, সুরমা, ও হাওড়া।
নেত্রকোনার প্রধান ফসল কী কী?
নেত্রকোনার প্রধান ফসল হল ধান, পাট, আলু, ও ভুট্টা।
উপসংহার
প্রিয় পাঠক, নেত্রকোনা কিসের জন্য বিখ্যাত নিশ্চয় এতক্ষনে বুঝতে পারছেন। আমরা নেত্রকোনা জেলা সম্পর্কে যতটা সম্ভব বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। সুতরাং আশা করছি এই পোস্টটি আপনার অনেক উপকারে আসবে। এছাড়াও আপনার জ্ঞানকে প্রসারিত করতে রংপুর কিসের জন্য বিখ্যাত এ সম্পর্কে পড়তে পারেন।
‘নেত্রকোনা কিসের জন্য বিখ্যাত‘ পোস্টটি কেমন লাগলো কমেন্ট করে জানাতে ভুলবেন না কেমন!