সাতক্ষীরা কিসের জন্য বিখ্যাত তার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। এই জেলাটি বাংলাদেশের মধ্যে অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে বিশেষভাবে পরিচিত। তাছাড়া সাতক্ষীরা জেলা বিখ্যাত হওয়ার আর একটি অন্যতম কারণ হচ্ছে সুন্দরবন। আবার, এই জেলায় রয়েছে অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গ এবং বিখ্যাত কিছু স্থান। সেই সাথে, সাতক্ষীরা জেলা মাছের জন্যও বিখ্যাত। তাহলে চলুন, সাতক্ষীরা কিসের জন্য বিখ্যাত তা আজকে বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক।
সাতক্ষীরা কিসের জন্য বিখ্যাত

সাতক্ষীরা বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত একটি জেলা। এটি তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, ঐতিহাসিক স্থাপত্য এবং সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের জন্য বিখ্যাত। সাতক্ষীরা জেলার বিখ্যাত স্থানগুলির মধ্যে আছে সাতক্ষীরা শহর, বাঘের গাড়ি, কুমড়ি নদী, আমুদিয়া মসজিদ, বাঁশখালী মসজিদ। সাতক্ষীরা জেলার মানুষেরা তাদের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি এবং আতিথেয়তার জন্যও বিখ্যাত। সাতক্ষীরার মানুষরা তাদের অতিথিদের খুব ভালোবাসেন।
সাতক্ষীরা জেলার নামকরণ ও ইতিহাস

সাতক্ষীরা জেলার নামকরণ নিয়ে বেশ কয়েকটি মতবাদ রয়েছে। একটি মতবাদ অনুসারে, এই অঞ্চলে সাতটি দীঘি ছিল বলে এর নাম সাতক্ষীরা। আরেকটি মতবাদ অনুসারে, এই অঞ্চলে সাতটি গ্রামের সমন্বয়ে একটি গ্রাম গড়ে উঠেছিল বলে এর নাম সাতক্ষীরা। সাতক্ষীরা জেলার ইতিহাস বেশ পুরনো। এই অঞ্চলে প্রাচীনকাল থেকেই মানব বসতি ছিল। খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীতে গুপ্ত সাম্রাজ্যের সময় এই অঞ্চল গুপ্তদের শাসনাধীন ছিল। এরপর পাল, সেন, মোঘল, বর্গী এবং ইংরেজদের শাসনাধীন ছিল। ১৮৬৯ সালে এই অঞ্চলকে খুলনা জেলার একটি মহকুমা হিসেবে গঠন করা হয়। ১৯৬০ সালে এই মহকুমাকে জেলায় রূপান্তরিত করা হয়।
সাতক্ষীরা জেলা বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত একটি জেলা। এটি ২২°৩৩′ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৯°১০′ পূর্ব দ্রাঘিমাংশের মধ্যে অবস্থিত। জেলার উত্তরে খুলনা জেলা, দক্ষিণে সাগর, পূর্বে বাগেরহাট জেলা এবং পশ্চিমে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য অবস্থিত। সাতক্ষীরা জেলার আয়তন ৩,৮৫৮.৩৩ বর্গকিলোমিটার। জেলার জনসংখ্যা প্রায় ২.৮ মিলিয়ন। জেলার প্রধান শহর এবং সদর দপ্তর হল সাতক্ষীরা। সাতক্ষীরা জেলার প্রধান অর্থনৈতিক ক্ষেত্র হল কৃষি। জেলার প্রধান ফসল হল ধান, পাট, গম, আখ, আলু, সরিষা, রসুন, পেঁয়াজ, বিভিন্ন ধরনের ডাল, শাকসবজি ইত্যাদি। এছাড়াও এখানে মৎস্য চাষ এবং চামড়া শিল্পও বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
সাতক্ষীরা জেলার বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গ
সাতক্ষীরা জেলার অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গ রয়েছেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন-
রাজা প্রতাপাদিত্য

বাংলার বারো ভূঁইয়াদের অন্যতম। তিনি সাতক্ষীরা জেলার কালিগঞ্জ এবং শ্যামনগর অঞ্চল শাসন করতেন।
শেখ নজরুল

শেখ নজরুল হলেন একজন বাংলাদেশী কবি, লেখক এবং গীতিকার। তিনি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি হিসেবে বিবেচিত। তিনি “বিদ্রোহী কবি” নামেও পরিচিত।
সৈয়দ জাহাঙ্গীর

সৈয়দ জাহাঙ্গীর ছিলেন একজন বাংলাদেশী চিত্রশিল্পী। তিনি ১৯৩৫ সালের ১লা নভেম্বর বাংলাদেশের সাতক্ষীরা জেলায় জন্মগ্রহণ করেন।
আহমদ ফজলুল হক

বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী। তিনি ১৯০৬ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার বাঁশদহ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
আজিজুর রহমান আহমেদ

বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ এবং রাজনীতিবিদ। তিনি ১৯২৬ সালের ১০ মে সাতক্ষীরায় জন্মগ্রহণ করেন।
পচাব্দী গাজী

সুন্দরবন অঞ্চলের পচাব্দী গাজী একজন কিংবদন্তি শিকারি। তিনি সুন্দরবন এলাকায় প্রচুর মানুষখেকো বাঘ শিকার করেছেন বলে জানা যায়। কিংবদন্তি এই শিকারি পচাব্দীর জন্ম ১৯২৫ সালে বাংলাদেশের সাতক্ষীরা জেলার সুন্দরবন অঞ্চলে।
আজিজুননেছা খাতুন
আজিজুননেছা খাতুন ছিলেন একজন বাংলাদেশী শিক্ষাবিদ, সমাজকর্মী এবং নারী অধিকার কর্মী। তিনি বাংলাদেশের প্রথম মহিলা এমএ পাসধারী। আজিজুন্নেছা খাতুনের জন্ম ১৮৯২ সালে বাংলাদেশের সাতক্ষীরা জেলার দেবহাটা উপজেলার জগন্নাথপুর গ্রামে।
খান বাহাদুর আহসান উল্লাহ

খান বাহাদুর আহসান উল্লাহ ছিলেন একজন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, শিক্ষা সংস্কারক, সমাজহিতৈষী এবং আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব। তিনি আহছানিয়া মিশনের প্রতিষ্ঠাতা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা।
ঠাকুরদাস মুখোপাধ্যায়

ঠাকুরদাস মুখোপাধ্যায় একজন বাঙালি সাহিত্যিক, সমালোচক, সম্পাদক এবং রসিক ব্যক্তিত্ব। তিনি বাংলা সাহিত্যের নবীন ভাষা-ছাঁচের অন্যতম প্রবক্তা এবং ব্যঙ্গ-রসিকতার জন্য বিখ্যাত।
শেখ আবুল কাশেম
শেখ আবুল কাশেম (১৯১৮-২০০৯) হলেন একজন বাংলাদেশী শিক্ষাবিদ, লেখক, গবেষক এবং মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এবং জাতীয় অধ্যাপক। তিনি বাংলাদেশের সাতক্ষীরা জেলার কালিকাপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
আব্দুল ওয়াদুদ খন্দকার
বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত সমাজসেবক। তিনি ১৯৩৬ সালের ১ জানুয়ারি সাতক্ষীরায় জন্মগ্রহণ করেন। এই ছাড়াও সাতক্ষীরা জেলায় আরও অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গ রয়েছেন। তারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের অবদানের জন্য স্মরণীয় হয়ে আছেন।
সাতক্ষীরা জেলার দর্শনীয় স্থান

সাতক্ষীরা জেলা তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, ঐতিহাসিক স্থাপত্য এবং সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের জন্য বিখ্যাত। জেলায় অনেক দর্শনীয় স্থান রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল:
সাতক্ষীরা শহর

সাতক্ষীরা শহরটি তার সুন্দর স্থাপত্য, ঐতিহাসিক নিদর্শন এবং সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের জন্য বিখ্যাত। শহরে রয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মহাত্মা গান্ধী এবং নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর স্মৃতিস্তম্ভ। এছাড়াও এখানে রয়েছে অনেক প্রাচীন মসজিদ, মন্দির এবং মঠ।
বাঘের গাড়ি
বাঘের গাড়ি হল একটি প্রাচীন স্থাপত্য। এটি সাতক্ষীরা শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। বাঘের গাড়িটি একটি পাথরের তৈরি স্থাপত্য। এটি একটি স্তম্ভের উপর দাঁড়িয়ে আছে। স্তম্ভটির উচ্চতা প্রায় ১০ মিটার।
কুমড়ি নদী

কুমড়ি নদী হল একটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত নদী। এটি সাতক্ষীরা শহর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। কুমড়ি নদীর তীরে রয়েছে অনেক প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। এছাড়াও এখানে রয়েছে অনেক ঐতিহাসিক স্থাপত্য।
আমুদিয়া মসজিদ

আমুদিয়া মসজিদ হল একটি প্রাচীন মসজিদ। এটি সাতক্ষীরা শহরের আমুদিয়া গ্রামে অবস্থিত। মসজিদটি ১৫শ শতাব্দীতে নির্মিত হয়েছিল। মসজিদটি তার সুন্দর স্থাপত্য এবং ঐতিহাসিক গুরুত্বের জন্য বিখ্যাত।
বাঁশখালী মসজিদ

বাঁশখালী মসজিদ হল একটি প্রাচীন মসজিদ। এটি সাতক্ষীরা শহরের বাঁশখালী গ্রামে অবস্থিত। মসজিদটি ১৬শ শতাব্দীতে নির্মিত হয়েছিল। মসজিদটি তার সুন্দর স্থাপত্য এবং ঐতিহাসিক গুরুত্বের জন্য বিখ্যাত।
নলতা শরীফ

নলতা শরীফ হল একটি ঐতিহাসিক স্থাপত্য। এটি সাতক্ষীরা জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার নলতা গ্রামে অবস্থিত। নলতা শরীফের প্রতিষ্ঠাতা হলেন হযরত শাহ সুলতান মাহমুদ শাহ। নলতা শরীফ বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান ইসলামী তীর্থস্থান।
মহারাজপুর মন্দির

মহারাজপুর মন্দির হল একটি ঐতিহাসিক স্থাপত্য। এটি সাতক্ষীরা জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার মহারাজপুর গ্রামে অবস্থিত। মহারাজপুর মন্দিরটি ১৮শ শতাব্দীতে নির্মিত হয়েছিল। মন্দিরটিতে দেবী কালীর একটি বিশাল মূর্তি রয়েছে।
সাতক্ষীরা জেলার বিখ্যাত খাবার
সাতক্ষীরা জেলা তার সুস্বাদু খাবারের জন্যও বিখ্যাত। জেলার বিখ্যাত খাবারগুলির মধ্যে রয়েছে
কাঁকড়া ভুনা

সাতক্ষীরা জেলার অন্যতম বিখ্যাত খাবার হল কাঁকড়া ভুনা। এটি সাতক্ষীরার সুন্দরবনের কাঁকড়া দিয়ে তৈরি করা হয়। কাঁকড়া ভুনা সাতক্ষীরা জেলার একটি জনপ্রিয় খাবার।
বাঁশখালীর ইলিশ

সাতক্ষীরার বাঁশখালী উপজেলার ইলিশ সারাদেশে বিখ্যাত। বাঁশখালীর ইলিশের স্বাদ অতুলনীয়।
কুমড়ি নদীর মাছ
সাতক্ষীরার কুমড়ি নদীর মাছও সারাদেশে বিখ্যাত। কুমড়ি নদীর মাছগুলি খুবই সুস্বাদু।
সাতক্ষীরা পায়েস

সাতক্ষীরা পায়েস সাতক্ষীরা জেলার একটি বিখ্যাত মিষ্টি। সাতক্ষীরা পায়েস তার সুস্বাদু এবং ঐতিহ্যবাহী স্বাদের জন্য বিখ্যাত।
সাতক্ষীরা লাডু

সাতক্ষীরা লাডু সাতক্ষীরা জেলার একটি বিখ্যাত মিষ্টি। সাতক্ষীরা লাডু তার সুস্বাদু এবং ঐতিহ্যবাহী স্বাদের জন্য বিখ্যাত।
সাতক্ষীরা জেলার প্রধান আকর্ষণ সুন্দরবন

সুন্দরবন হল বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন। এটি সাতক্ষীরা জেলার দক্ষিণে অবস্থিত। সুন্দরবনে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের বন্যপ্রাণী, যেমন বাঘ, হরিণ, বানর, কুমির, ইত্যাদি। সুন্দরবনে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের গাছপালা, যেমন সুন্দরী, গেওয়া, গরান, ইত্যাদি। সুন্দরবন বাংলাদেশের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন কেন্দ্র। সুন্দরবন সাতক্ষীরা জেলার প্রধান আকর্ষণ কারণ এটি একটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত স্থান।
সুন্দরবনে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের বন্যপ্রাণী, যা পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয়। সুন্দরবন বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ জীববৈচিত্র্য কেন্দ্র। সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সাতক্ষীরা জেলার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।সাতক্ষীরা জেলায় সুন্দরবনের পাশাপাশি আরও অনেক দর্শনীয় স্থান রয়েছে। তবে সুন্দরবন সাতক্ষীরা জেলার সবচেয়ে জনপ্রিয় দর্শনীয় স্থান। সুন্দরবনে প্রতি বছর হাজার হাজার পর্যটক বেড়াতে আসেন।
বহুল জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন-উত্তর সমূহ
ইতিমধ্যে সাতক্ষীরা জেলা নিয়ে অনেক কিছুই পোস্ট থেকে জেনেছেন। এত সুন্দর জেলার সৌন্দর্য নিশ্চয় আপনার মনে ভ্রমণের সাড়া ফেলেছে। সাতক্ষীরা কিসের জন্য বিখ্যাত এ সম্পর্কে জানার পরও নিশ্চয় আরও কিছু প্রশ্ন হয়তো আপনার মনে উঁকি দিচ্ছে। আসুন জেনে নেওয়া যাক সেই সকল প্রশ্ন এবং উত্তরসমূহ-
সাতক্ষীরা কিসের জন্য বিখ্যাত?
বাংলাদেশের মধ্যে সাতক্ষীরা চিংড়ি আর সন্দেশের জন্য বিখ্যাত। এছাড়াও দৃষ্টিনন্দন জেলা সাতক্ষীরা সুন্দরবনের জন্যও বিশেষভাবে খ্যাত।
সাতক্ষীরা কোন নদীর তীরে অবস্থিত?
সাতক্ষীরার আশে পাশে রয়েছে অনেক নদনদী। তবে সাতক্ষীরা পাঙ্গাশিয়া নদীর তীরে অবস্থিত।
উপসংহার
জনপ্রিয় জেলা সাতক্ষীরা বিখ্যাত হওয়ার কারণগুলো নিশ্চয় বুঝতে পারছেন। এই জেলার বিখ্যাত খাবার, দর্শনীয় স্থান, বিখ্যাত ব্যক্তি জেলাটিকে অন্যান্য জেলার তুলনায় করে তুলেছে অনন্য। এছাড়াও আপনার জ্ঞানকে প্রসারিত করতে জামালপুর কিসের জন্য বিখ্যাত সম্পর্কে পড়তে পারেন।
‘সাতক্ষীরা কিসের জন্য বিখ্যাত‘ পোস্টটি কেমন লাগলো দয়া করে কমেন্ট করে জানিয়ে দিবেন। আপনাদের সুস্বাস্থ্য কামনা করে আজকের মত বিদায় নিচ্ছি, আল্লাহ্ হাফেজ।